বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১৮

Raja Voja & Wood cutter

রাজা ভোজ ও কাঠুরে :- 

রাজা ভোজ ও অন্যান্য গল্প - - - , , , , , ,
রাজা ভোজ ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ রাজা, যার নাম যেকোন লোকের মুখে মুখে ফেরে । লোক কথায় কথায় বলে "কোথায় রাজা ভোজ আর কোথায় গঙ্গুতেলি" বা "ভোজবাজী পেয়েছিস ?" । 
রাজা ভোজ ছিলেন 'ধার' নগরীর রাজা ।  তিনি তার রাজ্যে ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষন করেন - - যা সর্বজনবিদীত । বিদ্বান ও গুনীদের সমাদোর করতে তিনি খুবই ভালোবাসতেন  । তার শাসনে তার রাজ্যে সংস্কৃত ভাষার উৎকর্ষতা চরমে ওঠে । সাধারণ লোকেরাও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে  । 

একবার রাজা ভোজ বেরিয়েছেন ভ্রমণে  ।  রাস্তায় দেখলেন এক কাঠুরে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে আসছে  । মাথায় কাঠের বোঝা বেশি দেখে রাজা ভোজ কাঠুরেকে শুধালেন - - "ভারো  বাধতি ? " অর্থাৎ কাঠের বোঝা কি কাঠুরেকে কষ্ট দিচ্ছে ? 

কাঠুরে জবাব দিল - - "ভারো ন বাধতে রাজন যথা বাধতে বাধতি "  অর্থাৎ "হে রাজন ! মাথার উপর বোঝা আমাকে যতনা কষ্ট দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পাচ্ছি আপনার মুখে 'বাধতি' শুনে।
রাজা ভোজ সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন ।  তার দ্বারা এমন ভূল হওয়া সম্ভব নয় । বাস্তবতা হল রাজা ভোজ তার নাগরিকদের সংস্কৃত ভাষায় কতটা জ্ঞান তা জানতে ইচ্ছুক ছিলেন ।  এজন্যই তিনি জেনেবুঝে 'বাধতে' শব্দকে 'বাধতি' বলেছেন । 
নিজের রাজ্যের সামান্য কাঠুরের মুখে সংস্কৃত ধাতুর শুদ্ধ প্রয়োগ শুনে রাজা ভোজ খুব আনন্দিত হন ও কাঠুরেকে পুরস্কৃত করেন । 
সংস্কৃত ভাষায় কিছু ক্রিয়াপদ আত্মনেপদী ও কিছু ক্রিয়াপদ পরস্মৈপদী হয় । কিছু ক্রিয়াপদ উভয়পদী হয় ।  অর্থাৎ আত্মনেপদী ও পরস্মৈপদী দুটিই প্রযুক্ত হয় । এইখানে সংস্কৃত বাক্যে আত্মনেপদী হবে ও 'বাধতি'  ।   

বুধবার, ৩০ মে, ২০১৮

Santhali folklore 2

সাঁওতালি উপকথা - - ২

সাঁওতালি উপকথা - - 

মৃতসংস্কার ও ভূমিকম্প

ওঁরাওদের কাছে "ধার্মেশ" সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। ........সকলে একত্রে একবার ভগবানের কাছে গেল; আকুতি জানিয়ে ধার্মেশকে বললেন, ‘ভগবান, আমাদের মাঝে মৃত্যু দাও।’ ধার্মেশ বললেন, ‘তোমরা কি সকলের জন্যই মৃত্যু চাও।’ উত্তরে সবাই বলে, ‘না, যারা বৃদ্ধ, তাদের জন্য শুধু মৃত্যু দাও।’ দেবতা ধার্মেশ তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন। ওঁরাওদের বিশ্বাস, সে থেকেই পৃথিবীতে মৃত্যুর আবির্ভাব হয়েছে।
তাহলে অন্য বয়সীদের কেন মৃত্যু হয়?.... ‘মানব সমাজে পাপের কারণে আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হয়। আর এই অপবিত্র আত্মা তখন দেবতা ধার্মেশের কাছে চলে যায় এবং মৃত্যু কামনা করে। ফলে তখনই মানুষের শরীরে রোগব্যাধি দেখা দেয় এবং দেহের মৃত্যু ঘটে।’ আদিবাসী ওঁরাওরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের শক্তিতে বিশ্বাস করে। ওঁরাও ভাষায় এটি ‘পাকবলার’। এর অর্থ ‘অশরীরী আত্মা’। এদের বিশ্বাস পূর্বপুরুষদের আত্মার এই শক্তিই তাঁদের ভালো আদিবাসী এবং আদর্শ ঐক্যের পথে শক্তি জোগায়। বেঁচে থাকা ওঁরাওদের জন্য মৃতরা তাদের আশীর্বাদ রেখে যায়। তাই এরা মৃতদের ভক্তি করে। ভাত খেতে বসে এরা ভাতের কিছু অংশ পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করে। কখনো কখনো নবজাতকের নাম রাখা হয় পূর্বপুরুষদের নামে, যাতে তাঁর আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
ভূমিকম্প নিয়ে ওঁরাওদের প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা। তারা মনে করে, পৃথিবী একটি কচ্ছপের পিঠের ওপর। কেঁচো পাতাল থেকে মাটি তুলে কচ্ছপের পিঠে ফেলে মই দিয়ে ওই মাটি সমান করে দেয়। এ কারণে পৃথিবীর কোথাও সমতল, কোথাও বা পাহাড়-পর্বত। কচ্ছপের মুখের সামনে নাগিনী সাপ ফণা তুলে বসে থাকে, যাতে কচ্ছপ নাড়াচড়া না করতে পারে। কচ্ছপ নাড়াচড়া করলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ওঁরাওদের কাছে গোত্র মহামূল্যবান। তাঁদের কাছে একই গোত্রের সকলেই ভাইবোন। ফলে এক গোত্রের মাঝে বিয়ে সম্পন্ন নিষিদ্ধ এবং পাপের সমতুল্য।.... ওঁরাওদের রয়েছে ২০টি গোত্র; নানা প্রাণী ও বস্তুর নামেই নামকরণ হয়েছে গোত্রগুলোর।
যেমন:-
১.  'টিগ্গা' অর্থ বানর,
২.  'বান্ডো' অর্থ বনবিড়াল,
৩.  'বাড়া' অর্থ বটগাছ,
৪.  'বাঁড়োয়া' অর্থ বন্যকুকুর,
৫.  'বাখলা' অর্থ এক প্রকার ঘাস,
৬.  'বেক' অর্থ লবণ,
৭.  'কেরকোটা' অর্থ চড়ুই পাখি,
৮.  'কিন্ড' অর্থ এক প্রকার মাছ,
৯.  'কিসপট্রা' অর্থ শূকরের নাড়িভুঁড়ি,
১০.  'কুজুর' অর্থ এক প্রকার লতাজাতীয় গাছ,
১১.  'লাকড়া' অর্থ বাঘ,
১২.  'মিঞ্জি' অর্থ এক প্রকার মাছ,
১৩.  'পান্না' অর্থ লোথা,
১৪.  'তির্কী' অর্থ এক জাতীয় মাছ,
১৫.  'টপ্প' অর্থ এক জাতীয় পাখি,
১৬.  'খাখা' অর্থ এক জাতীয় কাক,
১৭. 'খালখো' অর্থ এক জাতীয় মাছ,
১৮.  'খেস' অর্থ ধান,

Santhali folklore 1


সাঁওতালি উপকথা - ১



সাঁওতালি উপকথা - - 

খেরওয়াল বংশ ধরম পুথির" থেকে নেওয়া ঘটক কাহিনীটি... (SANTHALI MYTH)

ঘটককে কেন বাঘে খায় না?

বিয়ের ঘটক থাকে দুজন। একজন কনেপক্ষের, অন্যজন বরপক্ষের। একবার এক বিয়ের প্রস্তাবে কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশের নদী ও শিলদার নদীটি। কনেরবাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল সে জঙ্গলের ভিতর দিয়েই। সে জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব হতো প্রায়ই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী।
একবার কনেপক্ষের ঘটক বরের বাড়িতে যাচ্ছিল সে নদীর ধার দিয়ে। দূর থেকে ঘটককে যেতে দেখেই একটি বাঘিনী হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ল তার সামনে। হঠাৎ বাঘিনীকে দেখে ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঘিনী প্রথমে ঘটককে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলা করতে লাগল। এটাই বাঘদের নিয়ম। শিকারকে সঙ্গে সঙ্গে খায় না তারা।
সে সময় বাঘিনী ঘটককে জিজ্ঞেস করল, কে হে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে?
বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পেল। সে ভয়ে ভয়ে বলল, মহারানী, আমি ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।
ঘটকের উত্তরে বাঘিনীর বেশ কৌতূহল হলো। সে বলল, কেমন ধর্মের কাজ হে?
ঘটক বলল, আমি দুটি পরিবারকে একত্রিত করি। দুজন আলাদা লোককে একজনে পরিণত করি।
বাঘিনী বলে, কেমন করে?
ঘটক উত্তরে বলে, যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দেই আর যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করে দেই।
ঘটকের উত্তর শুনে বাঘিনীর নিজের কথা মনে হয়। সে বলে, যদি তাই হয়, আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। সে দুঃখ করে বলে, ১২ বছর আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা।
সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হলো। সে বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানী। ঘটককে বিশ্বাস করে বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিল।
ঘটকের ছিল তীক্ষ্ম বুদ্ধি। ছাড়া পেয়ে সে গেল সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। দোকান থেকে সে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিল। তা সেলাই করার জন্য কিনল একটি সুই ও দড়ি। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকত দুজন বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যে কোনো বিয়েতে তারাই হলুদ ও পাতা বাছাই করে দিত।
ঘটক সে বাড়িতে গিয়ে খুশি মনে তাদের বলল, যাও, একটু হলুদ বেটে এবং পাতা বেছে পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের খালা তৈরি কর। সেই খালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু। বুড়ো-বুড়ি তাই করল।
ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুই, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে গেল বাঘিনীর কাছে।
বাঘিনীকে সে বলল, মাহারাণী, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।
শুনে বাঘিনী তো মহা খুশি।
ঘটক বলল, যদি আমাকে বিশ্বাস কর এবং বিয়ে করতে চাও তবে তুমি এই বস্তার ভিতর প্রবেশ করো।
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথা মতো বস্তার ভিতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন সেই তেল-হলুদের খালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তাই করল।
ঘটক এবার সেই শনের দড়ি দিয়ে ঐ বস্তাটিকে ভালো করে সেলাই করল। অতঃপর বাঘিনীকে বলল, মহারাণী, নড়াচড়া করো না। তোমাকে এই নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নেবে তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিও।এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল।
সে দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীতেও বান দেখা দিয়েছে। অন্য একটি গ্রামে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে ১২ বছর আগে। সেই বাঘটি প্রতিদিন বান দেখতে নদীর ধারে এসে বসে থাকত। মাঝে মাঝে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে আসলেই নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেত। সেদিনও সে নদীর ধারে বসেছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে উপরে তুলে আনল। দাঁত দিয়ে বস্তাটি ছিঁড়তে যাবে ওমনি বস্তার ভিতর থেকে বাঘিনীর গর্জন।
বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেলল। ঠিক তখনই বাঘিনী মনের আনন্দে আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। সে হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দিল ওই পুরুষ বাঘটির মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকল। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুখে- শান্তিতে কাটতে থাকল বাঘ-বাঘিনীর জীবন।
এ কারণেই আদি থেকেই সাঁওতালরা মনে করে বাঘেরা ঘটকদের ওপর খুব খুশি। তাই ঘটককে কখনো বাঘেরা খায় না।

বুধবার, ২৩ মে, ২০১৮

More chanda

    

আরো কিছু ছন্দ ঃ


ব্যাকরণ ও ছন্দ - -  , , , , , , 
আর একটি শাখার উদগম হয়েছে সংস্কৃত ছন্দকে বাংলায় ভেঙে নিয়ে।
শার্দূলবিক্রীড়িত: 
ধিন ধিন ধিন/তা তা ধিন তা ধিন/তা তা তা ধিন/ধিন ধিন তা ধিন/ধিন তা ধিন


নিস্তার নাই;- /বাজে ভীম শানাই/; ভুসি-উষর,/দাঁড়কাক-ধূসর/ দু;সময়
অন্ধের হাত/ থাকে হাতড়াতেই/ সারাটা রাত,/ সাঁতড়াতেই/ বিশ্বময়!
(সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)

বসন্ততিলক: 
ধিন ধিন/তা ধিন তা তা/তা ধিন তা তা/ধিন তা ধিন ধিন

সুন্দর!   / তোমার কোরে/ বসত করে/ দিগ্বসন প্রেম!
ছিঁড়বই / প্রখর নখে/তোমার চুড়ি/দার চীনাংশুক।
কাম নয়, / কেবল আঁধি-/উধাও আঁধা/রের গোপন হেম-
মৃত্যুর  /ভিতর টানে/ আমায় ভূখা/ মৃত্যুভুক্‌ সুখ!
(সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
তোটক: 

তাতা ধিনতাতাধিন /তাতা ধিনতাতাধিন

প্রিয় আজকে আমার /শুধু ভাঙছে দুয়ার
ধু ধু উড়ছে পরাগ/কালো পাগলা ঝড়ে

বুকে বর্শা–সমেত/ ছোটে মত্ত শুয়ার,

তত শুক্র উছল,/যত রক্ত ঝরে!

                                          (সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)

*শেষ ‘ধিন’ এর জায়গায় ‘তা’ হতে পারে; সংস্কৃত ছন্দে এই স্বাধীনতাটুকু আছে।


মন্দাক্রান্তা: 
ধিন ধিন ধিন ধিন/ তা তা তা তা তা ধিন/ ধিন তা ধিন ধিন/ তা ধিন ধিন

প্রহর্ষিণী: 
ধিন ধিন ধিন/তা তা তা তা ধিন/তা ধিন তা/ ধিন ধিন
‘ঈশ্বর নাই /সরোষে ঘোষেন/অসীমকুমার দাস
সর্বক্ষণ।/তথাপি গোপন/ আনন্দ-উদ্ভাস
তার মজ্জায়/ রিলে ক’রে যায়/অতন্দ্র সঞ্জয়:
প্রত্য্‌ক প্রাণ/ ফেটে ফোটে গান,/ যাবজ্জীবেৎ- ‘জয়’!
(সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ)
মালিনীঃ 
তা তা তা তা তা তা/ ধিন ধিন/ ধিন তা ধিন ধিন/ তা ধিন ধিন


মত্তময়ূর: 
ধিন ধিন ধিন ধিন/ ধিন তা তা ধিন ধিন/ তা তা ধিন ধিন
অস্থির, উন্মাদ/  ছুটছে ভীষণ বেগ/তমসার ট্রেন
নিঃসাড় নিউরন/   বাজতেছে কর্কশ/ খ্যাপা সাইরেন।
চণ্ডাল এক ক্রোধ/  দ্বন্দ্ব-বিবাদ চায়/ফোঁসে টাইগ্রিস
রক্তের স্রোতটায়/   এক যে নাগিন তার/ ঢেলে দেয় বিষ।

রুক্মবতীঃ 
ধিন তা তা/ ধিন ধিন ধিন/ তা তা ধিন/ ধিন
কাঁপছে নদীর জল

দুলছিল নৌকা
বস্তুত নিশ্চল

নৌকাবোঝাই ফুল,
একপাশে মশলা;
আর ছিল চুপচাপ ভারবাহী গর্দভ

ব্রহ্মমূর্ধাঃ 
তা তা তা তা তা তা/ ধিন তা ধিন/ ধিন তা ধিন/ ধিন তা ধিন
যদিও বাতাসে/ খাচ্ছে পাক/আজ সবার/ নিন্দাবাদ,
যেহেতু ধরেছি/ হাত তোমার/দিই স্লোগান:/জিন্দাবাদ।
কেন থরো থরো/ প্রাণ আমার/যার বোঝার/ সেই বুঝুক,
যেহেতু সকলে/ খায় না মদ _/তৃষ্ণা যার/ সেই খুঁজুক।

মোটকঃ 
ধিন তা / তা ধিন /তা তা
ফাল্গু/নী ফুল /তুমি-
চোখ বোজো হরতালে,
ফের হয়ে যাও কলি,
বোম-বারুদের ত্রাসে।
মাতৃ-যোনির মুখে-
বাচ্চা আটক থাকে!-
হয় না বাহির ভয়ে;
যায় যদি আজ পুড়ে!

দ্রুতবিলম্বিত:
 তাতাতা/ধিনতাতা/ধিনতাতা/ধিনতাধিন
না বুঝে /আজ আমি /কার টানে/ ঘরছাড়া
সে কথা /মুখ ফুটে/ বলব না /কাউকে আর।
যে মেয়ে/ অভ্যাসে /বুক ভেঙে/ খুশ ছিল
কেন যে/ মুখ তুলে/ ডাক দিলো/ – “বাও খেয়া!”
( পীযূষ কান্তি বন্দ্যোপাধ্যায়)

বিজোহা/ স্বগ্রিণীঃ 
ধিন তা ধিন/ ধিন তা ধিন

দুলকি চাল /আশ্বিনের
ঢিমতেতাল/ বনবাদাড়,
বনমোরগ/ দিচ্ছে ডাক
মসজিদের/গম্বুজে
বিদ্যাধর:
 ধিন ধিন ধিন/ ধিন ধিন ধিন
বন প্রান্তেই/ সেই বৃদ্ধের /
ঘর সংসার, /তার দরজায়-/
এক রাইফেল, /দুই বন্দুক,
তিন আস্তিন,/ চার চামড়ার-
পাঁচ বস্তায় /ছয় সন্ধ্যায়
দুই হিম-চোখ /আজ ঠাঁই নেয়
শিখরিণী মালিনী মন্দাক্রান্তা শার্দূলবিক্রীড়িত প্রভৃতি বড়ো বড়ো গম্ভীরচালের ছন্দ গুরুলঘুস্বরের যথানির্দিষ্ট বিন্যাসে অসমান মাত্রাভাগের ছন্দ। বাংলায় আমরা বিষমমাত্রামূলক ছন্দ কিছু কিছু চালিয়েছি, কিন্তু বিষমমাত্রার ঘনঘন পুনরাবৃত্তির দ্বারা তারও একটা সম্মিতি রক্ষা হয়।

মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১৮

Akshar britta, amritakshar,


অক্ষরবৃত্ত, অমৃতাক্ষর, সনেট, দীগাক্ষর
ব্যাকরণ ও ছন্দ - - , , , , ,
এরপর আমরা আসব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছন্দের আলোচনায়, তা হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। 
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ :
• মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। 
• অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়। 
• অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়; শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা হয়। 
• কোন শব্দ এক অক্ষরের হলে, এবং সেই অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, সেই অক্ষরটির মাত্রা ২ হয়। 
• কোন সমাসবদ্ধ পদের শুরুতে যদি এমন অক্ষর থাকে, যার শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, তবে সেই অক্ষরের মাত্রা ১ বা ২ হতে পারে। 
• কবিতা আবৃত্তির গতি ধীর হয়।

উদাহরণ-
লক্ষ ঢাকঢোল
বাজিছে হোথায়।
চক্ষু হয় গোল,
লোকে মূৰ্ছা যায়।
এ হল ৪+২=৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। এত ছোটো মাপে যদি মন না ওঠে, তো এর সঙ্গে আরও চার মাত্রা জুড়ে দিয়ে ৪+৪+২=১০ মাত্রার লাইনও আমরা বানাতে পারি। ব্যাপারটা সেক্ষেত্রে এই রকমের দাঁড়াবে :
ওই শোনো প্ৰচণ্ড দাপটে
লক্ষ ঢাকঢোল বেজে যায়।
ভক্তের আসর জমে ওঠে
ঘন-ঘন-পতনে মূৰ্ছায়।
আরও বাড়াতে চান? বেশ তো বাড়ান না, ফি-লাইনে আরও চারটি করে মাত্রা জুড়ে দিন। দিলে হয়তো এই রকমের একটা চেহারা মিলতে পারে :
ওই শোনো সাড়ম্বরে প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ ঢোল বেজে যায়।
গর্জনে-হুংকারে ওই সভা জমে ওঠে
ভক্তদের ঘন-ঘন পতনে মূর্ছায়।
এ হল ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। 

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপভেদ বা প্রকারভেদ : অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আবার অনেকগুলো রূপভেদ বা প্রকার আছে- পয়ার, মহাপয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, দিগক্ষরা, একাবলী, সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ। নিচে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল-
দিগক্ষরা ছন্দ:  

ছন্দবদ্ধ কবিতার যে ছন্দ রীতিতে কবিতার প্রতিটি ছত্রেই দশটি করে বর্ণ থাকে এবং দশটি বর্ণ বিশিষ্ট একেকটি ছত্রেই এক একটি চরণ নিষ্পন্ন হয় , এবং পর পর এইরূপ দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যবর্ণে, অথবা প্রথম ছত্র বা চরণ ও তৃতীয় ছত্র বা চরণের অন্ত্যবর্ণে এবং দ্বিতীয় ছত্র বা চরণ ও চতুর্থ ছত্র বা চরণের অন্ত্যবর্ণে মিল রক্ষিত হয়, তাকে দিগক্ষরা ছন্দ বলে। উদাহরণ :

উদাহরণ ঃ

 --অক্ষয় কুমার বড়াল

তুচ্ছ শঙ্খসম এ হৃদয়
পড়িয়া সংসার-তীরে একা-প্রতি চক্রে আবর্তে রেখায়
কত জনমের স্মৃতি লেখা!
আসে যায় কেহ নাহি চায়
সবাই খুঁজিছে মুক্তামণি;
কে শুনিবে হৃদয় আমার
ধ্বনিছে কি অন্তরের ধ্বনি !
হে রমণীলওতুলে লও,
তোমাদের মঙ্গল-উৎসবে-একবার ওই গীতি-গানে
বেজে উঠি সুমঙ্গল রবে!
হে রথীহে মহারথীলও
একবার ফুৎকার’ সরোষে-বল-দৃপ্তপরস্ব-লোলুপ
মরে যাক এ বজ্র-নির্ঘোষে !
হে যোগীহে ঋষিহে পূজক,
তোমরা ফুৎকার’ একবার-আহুতি-প্রণতি-স্তুতি আগে
বহে আনি আশীর্বাদ-ভার!


কবি অক্ষয় কুমার ড়াল রচিত হৃদয়-শঙ্খ কবিতায় লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে দশটি করে বর্ণ আছে। প্রথম ও তৃতীয় এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ ছত্রের বা চরণের অন্ত্যবর্ণে মিল আছে। যেমন-

তুচ্ছ শঙ্খসম এ হৃদয় (২+৪+১+৩)=১০                ……প্রথম ছত্র। অন্ত্যবর্ণ = য়
প্রতি চক্রে আবর্তে রেখায় (২+২+৩+৩)=১০          ……তৃতীয় ছত্র। অন্ত্যবর্ণ = য়
পড়িয়া সংসার-তীরে একা* (+++)=১০     ….. দ্বিতীয় ছত্র।অন্ত্যবর্ণ = কা
কত জনমের স্মৃতি লেখা (+++)=১০          ……চতুর্থ ছত্র।অন্ত্যবর্ণ = খা

*সংসার শব্দের অনুস্বারকে বর্ণ হিসাবে গণনা করা হয় নাই।
সনেট :
• বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
• বাংলায় উল্লেখযোগ্য সনেট রচয়িতা- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, অক্ষয়কুমার বড়াল, ফররুখ আহমদ,কামিনী রায়, প্রমুখ
• ১৪ বা ১৮ মাত্রার চরণ হয়
• দুই স্তবকে ১৪টি চরণ থাকে
• সাধারণত দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮টি ও ৬টি চরণ থাকে (চরণ বিন্যাসে ব্যতিক্রম থাকতে পারে)
• প্রথম আটটি চরণের স্তবককে অষ্টক ও শেষ ৬টি চরণের স্তবককে ষটক বলে
• এছাড়া সনেটের অন্ত্যমিল ও ভাবের মিল আছে এমন চারটি চরণকে একত্রে চৌপদী, তিনটি পদকে ত্রিপদীকা বলে
• নির্দিষ্ট নিয়মে অন্ত্যমিল থাকে
• দুইটি স্তবকে যথাক্রমে ভাবের বিকাশ ও পরিণতি থাকতে হয়; ব্যাপারটাকে সহজে ব্যাখ্যা করতে গেলে তা অনেকটা এভাবে বলা যায়- প্রথম স্তবকে কোন সমস্যা বা ভাবের কথা বলা হয়, আর দ্বিতীয় স্তবকে সেই সমস্যার সমাধান বা পরিণতি বর্ণনা করা হয়
• সনেটের ভাষা মার্জিত এবং ভাব গভীর ও গম্ভীর হতে হয়
• সনেট মূলত ৩ প্রকার- পেত্রার্কীয় সনেট, শেক্সপীয়রীয় সনেট ও ফরাসি সনেট; এই ৩ রীতির সনেটের প্রধান পার্থক্য অন্ত্যমিলে। এছাড়া ভাব, বিষয় ও স্তবকের বিভাজনেও কিছু পার্থক্য আছে (তা ব্যাকরণের ছন্দ প্রকরণের আলোচ্য নয়)। নিচে ৩ প্রকার সনেটের অন্ত্যমিলের পার্থক্য দেখান হল-
পেত্রার্কীয় রীতি
ক+খ+খ+ক  ক+খ+খ+ক
চ+ছ+জ  চ+ছ+জ
শেক্সপীয়রীয় রীতি
ক+খ+ক+খ
গ+ঘ+গ+ঘ
চ+ছ+চ+ছ
জ+জ
ফরাসি রীতি
ক+খ+খ+ক  ক+খ+খ+ক
গ+গ  চ+ছ+চ+ছ
উদাহরণ-

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব ∣ বিবিধ রতন;- ∣∣  (৮+৬)        ক
তা সবে, (অবোধ আমি!) ∣ অবহেলা করি, ∣∣ (৮+৬)          খ
পর-ধন-লোভে মত্ত, ∣ করিনু ভ্রমণ ∣∣ (৮+৬)            ক
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি ∣ কুক্ষণে আচরি। ∣∣ (৮+৬)                খ    অষ্টক
কাটাইনু বহু দিন ∣ সুখ পরিহরি। ∣∣ (৮+৬)             খ
অনিদ্রায়, অনাহারে ∣ সঁপি কায়, মনঃ, ∣∣ (৮+৬)         ক
মজিনু বিফল তপে ∣ অবরেণ্যে বরি;- ∣∣ (৮+৬)               খ
কেলিনু শৈবালে, ভুলি ∣ কমল-কানন। ∣∣ (৮+৬)                ক

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী ∣ কয়ে দিলা পরে,- ∣∣ (৮+৬)         গ
ওরে বাছা, মাতৃকোষে ∣ রতনের রাজি ∣∣, (৮+৬)         ঘ
এ ভিখারী-দশা তবে ∣ কেন তোর আজি? ∣∣ (৮+৬)       ঘ    ষটক
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, ∣ যা রে ফিরি ঘরে। ∣∣ (৮+৬)           গ
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; ∣ পাইলাম কালে ∣∣ (৮+৬)         ঙ
মাতৃভাষা-রূপ খনি, ∣ পূর্ণ মণিজালে । ∣∣। (৮+৬)        ঙ
                (বঙ্গভাষা; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

কবিতাটিতে দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮ ও ৬ চরণ নিয়ে মোট ১৪টি চরণ আছে। প্রতিটি চরণে ৮ ও ৬ মাত্রার দুই পর্ব মিলে মোট ১৪ মাত্রা আছে।

অমিত্রাক্ষর ছন্দ :
• বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
• অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাবের প্রবহমানতা; অর্থাৎ, এই ছন্দে ভাব চরণ-অনুসারী নয়, কবিকে একটি চরণে একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করতেই হবে- তা নয়, বরং ভাব এক চরণ থেকে আরেক চরণে প্রবহমান এবং চরণের মাঝেও বাক্য শেষ হতে পারে
• বিরামচিহ্নের স্বাধীনতা বা যেখানে যেই বিরামচিহ্ন প্রয়োজন, তা ব্যবহার করা এই ছন্দের একটি বৈশিষ্ট্য
• অমিত্রাক্ষর ছন্দে অন্ত্যমিল থাকে না, বা চরণের শেষে কোন মিত্রাক্ষর বা মিল থাকে না
• মিল না থাকলেও এই ছন্দে প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ১৪) এবং পর্বেও মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ৮++৬)
উদাহরণ-

                     তথা
জাগে রথ, রথী, গজ, ∣ অশ্ব, পদাতিক ∣∣  (৮+৬)
অগণ্য। দেখিলা রাজা ∣ নগর বাহিরে, ∣∣  (৮+৬)
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ ∣ সিন্ধুতীরে যথা, ∣∣  (৮+৬)
নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা ∣ আকাশ-মণ্ডলে। ∣∣  (৮+৬)
                     (মেঘনাদবধকাব্য; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

এখানে কোন চরণের শেষেই অন্ত্যমিল নেই। আবার প্রথম বাক্যটি চরণের শেষে সমাপ্ত না হয়ে প্রবাহিত হয়ে একটি চরণের শুরুতেই সমাপ্ত হয়েছে (তথা জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক অগণ্য)। এই অন্ত্যমিল না থাকা এবং ভাবের বা বাক্যের প্রবহমানতাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য।

গদ্যছন্দ :
• এই ছন্দে বাংলায় প্রথম যারা কবিতা লিখেছিলেন তাদের অন্যতম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
• মূলত ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী শিল্পমুক্তির আন্দোলনের ফসল হিসেবে এর জন্ম
• গদ্য ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- গদ্যের মধ্যে যখন পদ্যের রঙ ধরানো হয় তখন গদ্যকবিতার জন্ম হয়
• পর্বগুলো নানা মাত্রার হয়, সাধারণত পর্ব-দৈর্ঘ্যে কোন ধরনের সমতা বা মিল থাকে না
• পদ ও চরণ যতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত হয়; এই বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন উচ্চারণের সুবিধার্থে নয়, বরং অর্থ প্রকাশের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়
• গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়ার সময় এক ধরনের ছন্দ বা সুরের আভাস পাওয়া যায়
• গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও এর পদবিন্যাস কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ও পুনর্বিন্যাসিত হতে হয়
উদাহরণ-
১।। ‘সূর্যদেব’ তোমার বামে এই সন্ধ্যা, তোমার দক্ষিণে ঐ প্রভাত, এদের তুমি মিলিয়ে দাও৷
 এর ছায়া ওর আলোটিকে একবার কোলে তুলে নিয়ে চুম্বন করুক,
 এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক৷’ (সন্ধ্যা ও প্রভাত)
২।। ‘যখন ঝিলীর ঝংকারে বেণুবনের অন্ধকার থর থর করছে যখন বাদল হাওয়ার দীপশিখা কেঁপে কেঁপে নিবে গেল, তখন সে তার অতি কাছের ঐ সংসারটাকে ছেড়ে দিয়ে আসুক ভিজে ঘাসের গন্ধেভরা বনপথ দিয়ে, আমার নিভৃত হূদয়ের নিশীথরাত্রে৷’ 
(মেঘদূত, ৫)
এই দুটি অংশই টানা গদ্যে লেখা৷ পদ্যের কোন ভাষা-রীতি এখানে নেই, ‘সাধারণ গদ্যের গদ্যধার্মিতাও নেই৷’ ছান্দসিক রামবহাল তেওরারী তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও হিন্দি ছন্দ’ গ্রন্থে গদ্য কবিতার তিনটি অপরিহার্য বিশেষত্বের কথা উলেখ করেছেন : 
১. শব্দধ্বনির গতি ও যতির আবর্তনের প্রত্যাশা বোধের তৃপ্তি 
২. ভাবের প্রত্যশিত স্পন্দমানতা 
৩. বাক্পর্বের প্রত্যাশিত বিন্যাস এবং শিল্পিত গদ্য৷
‘লিপিকা’র গদ্যকবিতা, পদ্যের মতো ভাবানুযায়ী খণ্ডিত পদে বিন্যস্তহয়নি, ‘পুনশ্চ’ কাব্যের (১৯৩২) ভূমিকায় সেই কৈফিয়তই কবি দিয়েছেন এভাবে ‘বোধ হয় ভীরুতাই তার কারণ৷’

সোমবার, ২১ মে, ২০১৮

Bengali chanda - - Poyar chanda


পয়ার ছন্দ ঃ

ব্যাকরণ ও ছন্দ - - , , , , , 
যে ছন্দ রীতিতে কবিতার প্রতিটি ছত্রেই আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সজ্জিত চৌদ্দটি করে বর্ণ থাকে এবং চৌদ্দ টি বর্ণ বিশিষ্ট একেকটি ছত্রেই এক একটি চরণ নিষ্পন্ন হয়, এবং সাধারণতঃ পর পর এইরূপ দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল থাকে, অথবা ক্ষেত্র বিশেষে প্রথম চরণ ও তৃতীয় চরণ এবং দ্বিতীয় চরণ ও চতুর্থ চরণের অন্ত্যমিল রক্ষিত হয় অথবা প্রথম চরণ ও চতুর্থ চরণ এবং দ্বিতীয় চরণ ও তৃতীয় চরণের অন্ত্যমিল রক্ষিত হয়, তাকে পয়ার ছন্দ বলে।

                পয়ার ছন্দে কবিতার প্রতিটি ছত্র বা চরণের শেষেই ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি ঘটে। এই ছন্দে শব্দের মধ্যবর্তী বা শেষে ব্যবহৃত খণ্ড ত এবং অনুস্বর কে বর্ণ  হিসাবে গণনা করা হয় না।

মধ্য যুগের বাংলা কাব্যে প্রধান ছন্দ রীতিই ছিল পয়ার। তাই মধ্যযুগে পয়ার ছন্দেই বাংলা ভাষায় রামায়ণ,মহাভারত, বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য ও নানা কাল জয়ী কাব্য রচিত হয়েছে। উনিশ শতকের পঞ্চম দশক সময়কাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কবিদের অধিকাংশই পয়ার ছন্দে কাব্য রচনা করে গেছেন এবং পয়ার ছন্দের সংস্কার সাধন করে ভিন্ন ভিন্ন পয়ার ছন্দের সৃষ্টি করে গেছেন।

ছন্দের বিন্যাস এবং অন্ত্যমিলের বিভিন্নতা অনুসারে বিশুদ্ধ পয়ার ছন্দকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়।

 যথা: 
১|| লঘু পয়ার, 
২|| পর্যায়সম পয়ার, 
৩|| মধ্যসম পয়ার, 
৪|| তরল পয়ার ও 
৫|| মালঝাঁপ।

পরবর্তী কালে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে আধুনিক চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পয়ারের প্রথম ছত্রে বা দ্বিতীয় ছত্রে চৌদ্দটির পরিবর্তে এক বা একাধিক সংখ্যক বর্ণ কমিয়ে বা বাড়িয়ে অথবা চরণের শেষে ভাবের আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি না ঘটিয়ে চরণ থেকে চরণান্তরে আংশিক বা সামগ্রিক পরিসমাপ্তি ঘটানোর প্রয়োজনীয়তায় ভিন্ন ভিন্ন পয়ার ছন্দের সৃষ্টি করা হয়। যেমন :

১|| প্রবহমান পয়ার 
২|| প্রবহমান পর্যায়সম পয়ার 
৩||  প্রবহমান মধ্যসম পয়ার 
৪||  হীনপদ পয়ার 
৫|| মহাপয়ার
৬||  প্রবহমান মহাপয়ার 
৭|| পর্যায়সম মহাপয়ার 
৮|| মধ্যসম মহাপয়ার
৯||  বিশাখ পয়ার এবং 
১০|| ভঙ্গ পয়ার।

১।। লঘু পয়ার :   

ছন্দবদ্ধ কবিতার যে ছন্দ রীতিতে কবিতার প্রতিটি ছত্রেই আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সজ্জিত চৌদ্দটি করে বর্ণ থাকে এবং চৌদ্দ টি বর্ণ বিশিষ্ট একেকটি ছত্রেই এক এক টি চরণ নিষ্পন্ন হয়, এবং পর পর এইরূপ দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল থাকে, তাকে লঘু পয়ার বলে। লঘু পয়ার ছন্দে প্রত্যেক ছত্রেই প্রথম আট বর্ণের পরে স্বল্প বিরতি দিয়ে পরের ছয় বর্ণ উচ্চারণ করতে হয়। উদাহরণ:

 (মনসামঙ্গল কাব্য --কবি বিজয় গুপ্ত) 

কামভাবে মহাদেব/ বলে অনুচিত।
লজ্জায় বিকল পদ্মা/ শুনিতে কুৎসিত।।
নাকে হাত দিয়া পদ্মা,/ বলে রাম রাম।
শিবের চরণে পড়ি/ করিল প্রণাম।।
পদ্মা বলে বাপ তুমি/ পরম কারণ।
না বুঝিয়া বল কেন/ কুৎসিত বচন।।¥
দেবের দেবতা তুমি/ পূজে ত্রিজগতে।
সকল সংসার তুমি/ জান ভালমতে।।¢
আপনি সকল জান/ মুই বলব কি।
চিনিতে নারিলা তুমি/ আপনার ঝি।।
চরণে ধরিয়া স্তুতি/ করে বার বার।
হেন ছার বাক্য তুমি/ না বলিও আর।।
বিজয় গুপ্ত বলে ভাই/ হও সাবহিত।$
এইকালে বল ভাই/ লাচারির গীত।।

কবি বিজয় গুপ্তের এই পয়ার ছন্দে লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে চৌদ্দটি করে বর্ণ আছে। পর পর দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল আছে এবং প্রতিটি ছত্রের বা চরণের বাক্য বা বাক্যাংশ কে আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সাজানো হয়েছে। যেমন-

কামভাবে মহাদেব (৪+৪) = ৮/ বলে অনুচিত (২+৪) = ৬ ।     অন্ত্যশব্দ = অনুচিত। 
লজ্জায় বিকল পদ্মা (৩+৩+২) = ৮/ শুনিতে কুৎসিত (৩+৩) = ৬।। এখানে ৎ কে বর্ণ হিসাবে ধরা হয় নাই। অন্ত্যশব্দ = কুৎসিত।
¥ না বুঝিয়া বল কেন (১+৩+২+২) = ৮/ কুৎসিত বচন (৩+৩) = ৬ ।। এখানে ৎ কে বর্ণ হিসাবে ধরা হয় নাই।
¢সকল সংসার তুমি (৩+৩+২) = ৮ / জান ভালমতে (২+৪) = ৬ ।। এখানে অনূস্বার কে বর্ণ হিসাবে ধরা হয় নাই।
$বিজয় গুপ্ত বলে ভাই (২+২+২+২) = ৮/ হও সাবহিত (২+৪) = ৬। এখানে য় কে শূণ্য মাত্রা  হিসাবে ধরা হয়েছে।

( ফুল্লরার বারমাস্যা ণ্ডীমঙ্গল কাব্য   --কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী) 

পাশেতে বসিয়া রামা/ কহে দুঃখবাণী।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি/ পত্রের ছাওনী।।
ভেরাণ্ডার খাম তার/ আছে মধ্য ঘরে।
প্রথম বৈশাখ মাসে/ নিত্য ভাঙ্গে ঝড়ে।।
অনল সমান পোড়ে/ বৈশাখের খরা।
তরুতল নাহি মোর/ করিতে পসরা।।
পদ পোড়ে খরতর/ রবির কিরণ।
শিরে দিতে নাহি আঁটে/ খুঞার বসন।।
বৈশাখ হইলো আগো/ মোরে বড় বিষ।
মাংস নাহি খায় সর্ব্ব/ লোক নিরামিষ।।
পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাসে/ প্রচণ্ড তপন।
খরতর পোড়ে অঙ্গ/ রবির কিরণ।।
পসরা এড়িয়া জল/ খাত্যে যাত্যে নারি।
দেখিতে দেখিতে চিলে/ লয় আধা সারি।।
অন্ন নাহি মেলে এই/ পাপ জষ্ঠি মাসে।
বেঙছির ফল খেঞা/ থাকি উপবাসে।।
ভূবন পুর্ণিত হৈল/ নবমেঘজল।
হেন কালে মৃগ মারে/ পাপ কর্মফল।।
মাংসের পসরা লয়্যা/ বুলি ঘরে ঘরে।
কিছু খুদ-কুড়া মিলে/ উদর না পূরে।।
কি কহিব দুঃখ মোর/ কহনে না যায়।
কাহারে বলিব কিবা/ দূষি বাপ মায়।।
শ্রাবণে বরিষে মেঘ/ দিবস রজনী।
সিতাসিত দুই পক্ষ/ একই না জানি।।
চারি মাসে বস্ত্রখানি/ হৈয়া গেল তুণ্ডা।
পালটিতে নাহি মোর/ একখানি মুণ্ডা।।
আচ্ছাদন নাহি অঙ্গে/ পড়ে মাংস-জল।
কত মাছি খায় অঙ্গে/ করমের ফল।।
অভাগ্য মনে গুণি/ অভাগ্য মনে গুণি।**
কত শত খায় জোঁক/ নাহি খায় ফণী।।
ভাদ্রপদ মাসে বড়/ দুরন্ত বাদল।
নদনদী একাকার/ আট দিকে জল।।
পসরা করিয়ে শিরে/ ফিরে ঘরে ঘরে।
অনলে পুড়এ অঙ্গ/ ভিতরে বাহিরে।।
ফিরাত পাড়াতে বসি/ না মেলে উধার।
হে বন্ধুজন নাহি/ যে বা সহে ভার।।
দুঃখ কর অবধান/ দুঃখ কর অবধান।**

 এই পয়ার ছন্দে লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে চৌদ্দটি করে বর্ণ আছে। পর পর দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল আছে এবং প্রতিটি ছত্রের বা চরণের বাক্য বা বাক্যাংশ কে আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সাজানো হয়েছে। যেমন-

পাশেতে বসিয়া রামা (৩+৩+২) = ৮/ কহে দুঃখবাণী (২+৪) = ৬। অন্ত্যশব্দ = দুঃখবাণী।
ভাঙ্গা কুড়্যা ঘরখানি (২+২+৪) = ৮/ পত্রের ছাওনী (৩+৩) = ৬।।   অন্ত্যশব্দ = ছাওনী।
** এই চরণে ব্যতিক্রম আছে। কবিতাকে শ্রুতিমধুর করার জন্য এমন করা হয়েছে।

   ( পাখী সব করে রব  - মদনমোহন তর্কালঙ্কার) 

পাখি সব করে রব,/ রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুম কলি,/ সকলি ফুটিল।।                                                  
রাখাল গরুর পাল,/ ল'য়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন/ নিজ নিজ পাঠে।।
ফুটিল মালতী ফুল,/ সৌরভ ছুটিল।
পরিমল লোভে অলি,/ আসিয়া জুটিল।।
গগনে উঠিল রবি,/ লোহিত বরণ।
আলোক পাইয়া লোক,/ পুলকিত মন।।
শীতল বাতাস বয়,/ জুড়ায় শরীর।
পাতায় পাতায় পড়ে,/ নিশির শিশির।।
উঠ শিশু মুখ ধোও,/ পর নিজ বেশ।
আপন পাঠেতে মন,/ করহ নিবেশ।।

*********************************

মদনমোহন তর্কালঙ্কারের এই কবিতায় লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে চৌদ্দটি করে বর্ণ আছে। পর পর দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল আছে এবং প্রতিটি ছত্রের বা চরণের বাক্য বা বাক্যাংশ কে আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সাজানো হয়েছে। যেমন-

পাখি সব করে রব (২+২+২+২) = ৮,/ রাতি পোহাইল (২+৪) = ৬। অন্ত্য শব্দ = পোহাইল।
কাননে কুসুম কলি (৩+৩+২) = ৮,/ সকলি ফুটিল (৩+৩) = ৬।।      অন্ত্য শব্দ = ফুটিল।

স্বাধীনতার সুখ    -- রজনীকান্ত সেন) 

বাবুই পাখিরে ডাকি / বলিছে চড়াই,
কুঁড়ে ঘরে থাকি কর / শিল্পের বড়াই:
আমি থাকি মহাসুখে/ অট্টালিকা পরে,
তুমি কত কষ্ট পাও / রোদ-বৃষ্টি ঝড়ে।
বাবুই হাসিয়া কহে,/ সন্দেহ কী তায়,
কষ্ট পাই,তবু থাকি/ নিজের বাসায়।
পাকা হোক,তবু ভাই,/ পরের ও বাসা,
নিজ হাতে গড়া মোর/ কাঁচা ঘর, খাসা।

************************************

রজনীকান্ত সেনের এই কবিতায় লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে চৌদ্দটি করে বর্ণ আছে। পর পর দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল আছে এবং প্রতিটি ছত্রের বা চরণের বাক্য বা বাক্যাংশ কে আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সাজানো হয়েছে। যেমন-

বাবুই পাখিরে ডাকি (৩+৩+২) = ৮/ বলিছে চড়াই (৩+৩) = ৬,       অন্ত্য শব্দ = চড়াই।
কুঁড়ে ঘরে থাকি কর (২+২+২+২) = ৮/ শিল্পের বড়াই (৩+৩) = ৬;   অন্ত্য শব্দ = বড়াই।

 (তপসে মাছ - - - ঈশ্বর গুপ্ত 

 কষিত-কনককান্তি/ কমনীয় কায়।
 গালভরা গোঁফ-দাড়ি/ তপস্বীর প্রায়॥
 মানুষের দৃশ্য নও/ বাস কর নীরে।
 মোহন মণির প্রভা/ ননীর শরীরে॥
 পাখি নও কিন্তু ধর/ মনোহর পাখা।
 সমধুর মিষ্ট রস/ সব-অঙ্গে মাখা॥
 একবার রসনায়/ যে পেয়েছে তার।
 আর কিছু মুখে নাহি/ ভাল লাগে তার॥
 দৃশ্য মাত্র সর্ব গাত্র/ প্রফুল্লিত হয়।
 সৌরভে আমোদ করে/ ত্রিভুবনময়॥
 প্রাণে নাহি দেরি সয়/ কাঁটা আঁশ বাছা।
 ইচ্ছা করে একেবারে/ গালে দিই কাঁচা॥
 অপরূপ হেরে রূপ/ পুত্রশোক হরে।
 মুখে দেওয়া দূরে থাক/ গন্ধে পেট ভরে॥
 কুড়ি দরে কিনে লই/ দেখে তাজা তাজা।
 টপাটপ খেয়ে ফেলি/ ছাঁকাতেলে ভাজা॥
 না করে উদর যেই/ তোমায় গ্রহণ।
 বৃথায় জীবন তার/ বৃথায় জীবন॥
 নগরের লোক সব/ এই কয় মাস।
 তোমার কৃপায় করে/ মহা সুখে বাস॥


ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত-র এই কবিতায় লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে চৌদ্দটি করে বর্ণ আছে। পর পর দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল আছে এবং প্রতিটি ছত্রের বা চরণের বাক্য বা বাক্যাংশ কে আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সাজানো হয়েছে। যেমন-

কষিত-কনককান্তি (৩+৫) = ৮/ কমনীয় কায়। (৪+২) = ৬,         অন্ত্য শব্দ = কায়।
গালভরা গোঁফ-দাড়ি (৪+২+২) = ৮/ তপস্বীর প্রায় (৪+২) = ৬।    অন্ত্য শব্দ = প্রায়।
 (খেয়া  --রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর) 

খেয়ানৌকা পারাপার/ করে নদীস্রোতে;
কেহ যায় ঘরে,কেহ/ আসে ঘর হতে।
দুই তীরে দুই গ্রাম/ আছে জানাশোনা,
সকাল হইতে সন্ধ্যা/ করে আনাগোনা।
পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব,/ কত সর্বনাশ,
নূতন নূতন কত/ গড়ে ইতিহাস-
রক্তপ্রবাহের মাঝে/ ফেনাইয়া উঠে,
সোনার মুকুট কত/ ফুটে আর টুটে !
সভ্যতার নব নব/ কত তৃষ্ণা ক্ষুধা-
উঠে কত হলাহল/ উঠে কত সুধা !
শুধু হেথা দুই তীরে,/ কে বা জানে নাম,
দোঁহা-পানে চেয়ে আছে/ দুইখানি গ্রাম।
এই খেয়া চিরদিন/ চলে নদীস্রোতে-
কেহ যায় ঘরে,কেহ/ আসে ঘর হতে।।


রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের এই কবিতায় লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে চৌদ্দটি করে বর্ণ আছে। পর পর দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যমিল আছে এবং প্রতিটি ছত্রের বা চরণের বাক্য বা বাক্যাংশকে আট-ছয় মাত্রা বিভাগের দুইটি পর্বে সাজানো হয়েছে। যেমন-

 খেয়ানৌকা পারাপার (৪+৪) = ৮/ করে নদীস্রোতে (২+৪) = ৬;              অন্ত্য শব্দ = স্রোতে।
 কেহ যায় ঘরে, কেহ (২+২+২+২) = ৮/ আসে ঘর হতে (২+২+২) = ৬।   অন্ত্য শব্দ = হতে।
পরের পর্ব



Bengali Byakoron

ছন্দ পরিচয়

ব্যাকরণ ও ছন্দ - -, , , , , , , , 
অক্ষর : (বাগযন্ত্রের) স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বলে। এই অক্ষর অনেকটাই ইংরেজি Syllable-র মত। যেমন-
শর্করা- শর,ক, রা- ৩ অক্ষর
পরিবার - প, রি, বা, র- ৪ অক্ষর
শান্ত - শান্, ত- ২ অক্ষর

যতি বা ছন্দ-যতি : কোন বাক্য পড়ার সময় শ্বাসগ্রহণের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অন্তর অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি নেয়া হয়, তাকে ছন্দ-যতি বা শ্বাস-যতি বলে।

যতি মূলত ২ প্রকার- 
হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি।
 অল্পক্ষণ বিরতির জন্য সাধারণত বাক্য বা পদের মাঝখানে হ্রস্ব যতি দেওয়া হয়। আর বেশিক্ষণ বিরতির জন্য, সাধারণত বাক্য বা পদের শেষে দীর্ঘ যতি ব্যবহৃত হয়।

অক্ষর : (বাগযন্ত্রের) স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোঁকে শব্দের যে অংশটুকু উচ্চারিত হয়, তাকে অক্ষর বা দল বলে। এই অক্ষর অনেকটাই ইংরেজি Syllable-র মত। যেমন-
প্রতিক - প্র,তি, ক- ৩ অক্ষর
পরিবার - প, রি, বা, র- ৪ অক্ষর
শান্ত - শান্, ত- ২ অক্ষর

যতি বা ছন্দ-যতি : কোন বাক্য পড়ার সময় শ্বাসগ্রহণের সুবিধার জন্য নির্দিষ্ট সময়ে অন্তর অন্তর যে উচ্চারণ বিরতি নেয়া হয়, তাকে ছন্দ-যতি বা শ্বাস-যতি বলে।
যতি মূলত ২ প্রকার- হ্রস্ব যতি ও দীর্ঘ যতি।
 অল্পক্ষণ বিরতির জন্য সাধারণত বাক্য বা পদের মাঝখানে হ্রস্ব যতি দেওয়া হয়। আর বেশিক্ষণ বিরতির জন্য, সাধারণত বাক্য বা পদের শেষে দীর্ঘ যতি ব্যবহৃত হয়।

পর্ব : বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমন-
একলা ছিলেম ∣ কুয়োর ধারে ∣ নিমের ছায়া ∣ তলে ∣∣
কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
( ∣ - হ্রস্ব যতি ও ∣∣ - দীর্ঘ যতি)
এখানে একলা ছিলেম, কুয়োর ধারে, নিমের ছায়া, তলে- প্রতিটিই একেকটি পর্ব; মানে প্রতিটি চরণে ৪টি করে পর্ব।

মাত্রা : একটি অক্ষর উচ্চারণে যে সময় প্রয়োজন হয়, তাকে মাত্রা বলে। বাংলায় এই মাত্রাসংখ্যার নির্দিষ্ট নয়, একেক ছন্দে একেক অক্ষরের মাত্রাসংখ্যা একেক রকম হয়। মূলত, এই মাত্রার ভিন্নতাই বাংলা ছন্দগুলোর ভিত্তি। বিভিন্ন ছন্দে মাত্রাগণনার রীতি বিভিন্ন ছন্দের আলোচনায় দেয়া আছে।

শ্বাসাঘাত : প্রায়ই বাংলা কবিতা পাঠ করার সময় পর্বের প্রথম অক্ষরের উপর একটা আলাদা জোর দিয়ে পড়তে হয়। এই অতিরিক্ত জোর দিয়ে পাঠ করা বা আবৃত্তি করাকেই বলা হয় শ্বাসাঘাত বা প্রস্বর।
 যেমন-
দেখে শেখা |শখে শেখা |শেখা বন্ধু | চক্রে ||
দুঃখ ব্যথা |ব্যর্থ গ্রাসে | মাদ্যাসক্ত | বক্সে ||
----( মাদকাসক্তি - অন্তকীর্তি) 
আমরা আছি ∣ হাজার বছর ∣ ঘুমের ঘোরের ∣ গাঁয়ে ∣∣
আমরা ভেসে ∣ বেড়াই স্রোতের ∣ শেওলা ঘেরা ∣ নায়ে ∣∣ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

এখানে প্রতিটি পর্বের প্রথম অক্ষরই একটু ঝোঁক দিয়ে, জোর দিয়ে পড়তে হয়। এই অতিরিক্ত ঝোঁক বা জোরকেই শ্বাসাঘাত বলে। : বাক্য বা পদের এক হ্রস্ব যতি হতে আরেক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলা হয়। যেমন-
একলা ছিলেম ∣ কুয়োর ধারে ∣ নিমের ছায়া ∣ তলে ∣∣
কলস নিয়ে ∣ সবাই তখন ∣ পাড়ায় গেছে ∣ চলে ∣∣ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
( ∣ - হ্রস্ব যতি ও ∣∣ - দীর্ঘ যতি)
এখানে একলা ছিলেম, কুয়োর ধারে, নিমের ছায়া, তলে- প্রতিটিই একেকটি পর্ব; মানে প্রতিটি চরণে ৪টি করে পর্ব।
পদ ও চরণঃ
পূৃর্ণ যতি বা দীর্ঘ যতি ছাড়াও এই দুই যতির মধ্যবর্তী বিরতির জন্য মধ্যযতির ব্যবহার হয়। দুই দীর্ঘ যতির মধ্যবর্তী অংশকে চরণ বলে। আর মধ্যযতি দ্বারা বিভক্ত চরণ গুলোকে বলে পদ। যেমন-
তরু তলে আছি/ একেলা পড়িয়া | দলিত পত্র/ শয়নে//
তোমাতে আমাতে/ রতছিনু যবে | কাননে কুসুম/ চয়নে// ---( রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর)
এখানে '|' চিহ্ন দ্বারা মধ্যযতি বোঝানো হয়েছে। পূৃর্ণ যতি দ্বারা আলাদা করা অংশ দুইটিকে চরণ বলে। '|' চিহ্নের উভয় অংশকে পদ বলে।

স্তবকঃ
অনেক গুলো চরণ মিলে একটি স্তবক গঠিত হয়। সাধারনত একটি স্তবকে একটি ভাব প্রকাশিত হয়।
মিল বা অন্তমিলঃ
একাধিক পদ, পর্ব বা চরণের শেষে একই রকম ধ্বনীগুচ্ছের ব্যবহারকে মিল বলে। অলংকারের ভাষায় একে অনুপ্রাস'ও বলা হয়। 

বাংলা পদ্য সাহিত্যে ছন্দ তিন প্রকার।
যথাঃ ১) অক্ষর বৃত্ত ছন্দ
২) মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এবং
৩) স্বরবৃত্ত ছন্দ
১) অক্ষর বৃত্ত ছন্দঃ
এখানে প্রতিটি বর্ণ বা অক্ষর এক একটি মাত্রা বহন করে। অর্থাৎ এখানে চোখের হিসাব নিকাশ। বিনয় মজুমদার একটা বেশ ভাল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতানুসারে, যে বর্ণের উপর মাত্রা আছে, তাই তার মাত্রা। যেমন 'অ' অক্ষরের উপর মাত্রা আছে। তাই এটি এক মাত্রা বহন করে। আবার যুক্তবর্ণেও এক মাত্রা ধরা হয়। যেমন- ল্ল, জ্জ্ব, স্ক, ঙ্গ, ইদ্যাদি সব এক মাত্রা বহন করে। আবার 'ৎ' অক্ষরে কোনো মাত্রা নেই। তাই উৎছন্ন শব্দটি তিন মাত্রার। 
কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম আছে। স্বরবর্ণ যেমন- 'এ' সর্বদাই এক মাত্রা বহন করে। 'ও' আবার মাঝখানে শুন্য মাত্রা এবং প্রথমে থাকলে এক মাত্রা হিসাব করতে হয়। যেমন- 'খাওয়া', 'দাওয়া' দুই মাত্রার শব্দ। 'ওদের' তিন মাত্রার শব্দ এবং 'ওর' দু'মাত্রার শব্দ।
ব্যঞ্জনবর্ণ - 'ঙ' এবং 'ৎ' শেষে বসলে এক মাত্রা। যেমন- 'রঙ' দুই মাত্রা এবং 'উচিৎ', হঠাৎ, অর্থাৎ, প্রভৃতি তিন মাত্রার। 'ঙ' যুক্তাক্ষরে এক মাত্রা বহন করে। যেমন- 'কঙ্কাল', অঙ্ক, 'অঙ্কন', ইত্যাদি। আবার 'ৎ' মাঝখানে বসলে শূন্যমাত্রা।যেমন- 'উৎস' দু'মাত্রার।
অক্ষর বৃত্ত ছন্দে প্রতি পর্বে চার মাত্রা এবং শেষে দু'মাত্রার অতিপর্ব থাকে। অর্থাৎ চার এর গুনিতক + ২।
যেমন-
৪*১+২= ৬
৪*২+২=১০
৪*৩+২=১৪
৪*৪+২=১৮
৪*৫+২=২২
২৬,৩০,৩৪, এভাবে চলতে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি মাত্রার লাইন কেবল জীবনানন্দ দাশ'ই লিখেছেন।
ছয় মাত্রার অক্ষর বৃত্ত ছন্দঃ 
ছয়মাত্রার অক্ষর বৃত্তছন্দের উদাহরণ নিম্নে পর্যালোচনা করা যাক।
এসো এসো/ প্রিও//
তব প্রাণ/ জিও//
তব লাগি/ প্রাণ//
করে দিব/ দান//
যদি চাও/ তুমি//
দিয়েদিব/ আমি//
জনমের/ মত//
দেব আছে/ যত//
যতক্ষণ/ আছে//
প্রাণবায়ূ/ শ্বাসে//

দশমাত্রার অক্ষর বৃত্তছন্দঃ
চল দেখি বানানো যায় কিনা দশ মাত্রার অক্ষর বৃত্তছন্দ।
পাঠকের/ মনভরে/ না'ক//
দরবারে/ কবিদের/ ডাক//
বুঝিবার/ নাহি পারি/ কবি//
দাঁত ভাঙা/ শব্দগুচ্ছ/ একি//
বলদেখি/ কি করেছ/ কবি//
নরপতি/ বলে দিল/ সবি//
ছয় মাত্রা ভাঙার যদিও কোন নিয়ম নেই। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে প্রতিটি লাইনকে দুইটি মহাপর্বে ভাগ করতে হয়। প্রথম পর্বে আট মাত্রা, পরের টিতে বাকিগুলো। যেমন-
১০ মাত্রা = ৮ + ২
১৪ মাত্রা = ৮ + ৬
১৮ মাত্রা = ৮ + ১০
২২ মাত্রা = ৮ + ১৪
বাকিগুলো এভাবেই চেষ্টা করতে হবে। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এ ব্যাপারে বলেন,
" বিজোড়ে বিজোড়ে গাঁথো
জোড়ে গাঁথো জোড়।"
অর্থাৎ বিজোড় শব্দের সাথে বিজোড় শব্দ এবং জোড় শব্দের সাথে জোড় শব্দ ব্যবহার করতে হবে। তাহলে পাঠকের আর পড়তে ও শুনতে আর অস্থিরতা লাগবেনা।
২) স্বরবৃত্ত ছন্দঃ
এখানে কানে বিচার করতে হবে। অর্থাৎ শ্রবণ শক্তির উপর জোর দিতে হবে। কারন এখানে বদ্ধস্বর একমাত্রা এবং মুক্তস্বর একমাত্রা বহন করে। ছড়া এই ছন্দে লেখা হয়। মূল পর্ব সর্বদাই চার মাত্রার হয়। প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষরে শ্বাসাঘাত হয়। দ্রুত লয় প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ কবিতা দ্রুত আবৃত্তি করতে হয়। যেমন-
(১) কাঠামোঃ ৪ + ৪ + ৪ + ১
মাত্রা বিন্যাসঃ
বাঁশ বাগানের/ মাথার উপর/ চাঁদ উঠেছে/ ওই//
মাগো আমার/ শোলক বালা/ কাজলা দিদি/ কই//
---( যতীন্দ্র মোহন বাগচী)
এখানে অক্ষের নিচে (_) চিহ্ন দ্বারা স্বাসাঘাত নির্দেশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে একটু ঝোঁক দিয়ে পড়তে হয়। আর লাইনের শেষের অক্ষর গুলোতে মিল বা অনুপ্রাস পরিলক্ষিত হয়।
(২) কাঠামোঃ ৪ + ৪ + ৪ + ২
মাত্রা বিন্যাসঃ
যখন ওরা/ অপিসে যায়/ কিংবা চালায়/ তুমুল দোকান/ দারি//
তখন আমি/ ঢেউ সাজানো/ নদীর বুকে/ দিব্যি জমাই/ পাড়ি//
--- ( যখন ওরা - শামসুর রহমান) 
এখানে চার মাত্রার চারটি পর্ব এবং দুই মাত্রার একটি অতিপর্ব দিয়ে পঙক্তি গঠিত হয়েছে। 
(৩) কাঠামোঃ ৪ + ৪ + ৩
মাত্রা বিন্যাসঃ
মেঘনা নদীর/ শান্ত মেয়ে/ তিতাসে//
মেঘের মতো/ পাল উড়িয়ে/ কী ভাসে//
--- ( ভর দুপুর - আল মাহমুদ) 
এখানে চার মাত্রার দুইটি পর্ব এবং তিন মাত্রার একটি অতিপর্ব রয়েছে।
এগুলো ছাড়াও ৪ + ৫, ৭ + ৪ মাত্রার স্বরবৃত্ত পরিলক্ষিত হয়।
যেমন-
বাবুদের তাল পুকুরে
হাবুদের ডাল কুকুরে
সেকি বাস করল তারা
বলি থাম একটু দাঁড়া।
--- ( লিচুচোর - কাজী নজরুল ইসলাম) 
এখানে প্রতিটি লাইন সাত মাত্রার। একটি মাত্র পর্ব দিয়ে গঠিত। 
আগুনের পরশ মনি/ ছোঁয়াও পানে,
এজীবন পূৃণ্য করো/ দহন দানে।
আমার এই দেহখানি/ তুলে ধরো,
তোমার ওই দেবালয়ের/ প্রদীপ করো
নিশিদিন আলোক শিখা/ জ্বলুক গানে।
--- ( পরশমনি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 
এখানে লক্ষনীয় যে,প্রতিটি লাইনের প্রথমে সাত মাত্রার একটি পর্ব ও শেষে চার মাত্রার একটি অতিপর্ব আছে।
৩) মাত্রাবৃত্ত ছন্দঃ
এক্ষেত্রে বদ্ধস্বর দু'মাত্রা বহন করে এবং মুক্তস্বর এক মাত্রা বহন করে। কোনো অবস্থাতেই বদ্ধস্বর এক মাত্রা বহন করবে না। এখানে যুক্তাক্ষরকে আলাদা মাত্রা হিসাব করতে হবে। যেমন- কষ্ট = 'ক-ষ্-ট' তিন মাত্রার। ছন্দ = 'ছ-ন্-দ' তিন মাত্রার। তবে যুক্তবর্ণ শব্দের প্রথমে থাকলে ভাঙানো যায় না। এক্ষেত্রে মাত্রাবৃত্তেও এক মাত্রা ধরা হয়। মাত্রাবৃত্ত ছন্দের চাল বিভিন্ন মাত্রার হয়ে থাকে। যেমন- ৪,৫,৬,৭ মাত্রার চাল। অতিপর্ব চাইলে ১,২, বা ৩ মাত্রার রাখা যাবে। কিন্তু কখনো অতিপর্বের মাত্রা পর্বের চেয়ে বেশি হওয়া যাবে না।
যেমন- ছয় মাত্রার কাঠামো
৬ + ৬ + ৬ + ২
মাত্রা বিন্যাসঃ
এ জগতে হায়/ সেই বেশি চায়/ আছে যার ভূরি/ ভূরি
রাজার হস্ত/ করে সমস্ত/ কাঙালের ধন/ চুরি।
--- ( দুইবিঘে জমি - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) 
পাঁচ মাত্রার পর্ব এবং দু'মাত্রার অতিপর্বঃ
কবিতা কাঠামোঃ ৫ + ৫ + ২
মাত্রা বিন্যাসঃ
এভূজ মাঝে/ হাজার রূপ/ বাতি
আচম্বিতে/ প্রসাদ হারা/ য়েছে;
আমার হাতে/ দেবীরা সুধা/ এনে,
গরল নিয়ে/ নরকে চলে/ গেছে।
--- ( নিরুক্তি - সুধীন্দ্রনাথ দত্ত)

এরূপ আর একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
আসতে যেতে/ এখনো তুলি/ চোখ
রেলিঙে আর/ দেখিনা নীল/ শাড়ি।
কোথায় যেন/ জমেছে কিছু/ শোক,
ভেঙেছে খোলা/ সহসা দিয়ে/ আড়ি।
---( নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)