About us

মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১৮

Akshar britta, amritakshar,


অক্ষরবৃত্ত, অমৃতাক্ষর, সনেট, দীগাক্ষর
ব্যাকরণ ও ছন্দ - - , , , , ,
এরপর আমরা আসব আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ছন্দের আলোচনায়, তা হল অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। 
অক্ষরবৃত্ত ছন্দ :
• মূল পর্ব ৮ বা ১০ মাত্রার হয়। 
• অক্ষরের শেষে স্বরধ্বনি থাকলে ১ মাত্রা গুনতে হয়। 
• অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, এমন অক্ষর শব্দের শেষে থাকলে ২ মাত্রা হয়; শব্দের শুরুতে বা মাঝে থাকলে ১ মাত্রা হয়। 
• কোন শব্দ এক অক্ষরের হলে, এবং সেই অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকলে, সেই অক্ষরটির মাত্রা ২ হয়। 
• কোন সমাসবদ্ধ পদের শুরুতে যদি এমন অক্ষর থাকে, যার শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি আছে, তবে সেই অক্ষরের মাত্রা ১ বা ২ হতে পারে। 
• কবিতা আবৃত্তির গতি ধীর হয়।

উদাহরণ-
লক্ষ ঢাকঢোল
বাজিছে হোথায়।
চক্ষু হয় গোল,
লোকে মূৰ্ছা যায়।
এ হল ৪+২=৬ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। এত ছোটো মাপে যদি মন না ওঠে, তো এর সঙ্গে আরও চার মাত্রা জুড়ে দিয়ে ৪+৪+২=১০ মাত্রার লাইনও আমরা বানাতে পারি। ব্যাপারটা সেক্ষেত্রে এই রকমের দাঁড়াবে :
ওই শোনো প্ৰচণ্ড দাপটে
লক্ষ ঢাকঢোল বেজে যায়।
ভক্তের আসর জমে ওঠে
ঘন-ঘন-পতনে মূৰ্ছায়।
আরও বাড়াতে চান? বেশ তো বাড়ান না, ফি-লাইনে আরও চারটি করে মাত্রা জুড়ে দিন। দিলে হয়তো এই রকমের একটা চেহারা মিলতে পারে :
ওই শোনো সাড়ম্বরে প্রচণ্ড দাপটে
মহোল্লাসে লক্ষ লক্ষ ঢোল বেজে যায়।
গর্জনে-হুংকারে ওই সভা জমে ওঠে
ভক্তদের ঘন-ঘন পতনে মূর্ছায়।
এ হল ৪+৪+৪+২=১৪ মাত্রার অক্ষরবৃত্ত। 

অক্ষরবৃত্ত ছন্দের রূপভেদ বা প্রকারভেদ : অক্ষরবৃত্ত ছন্দের আবার অনেকগুলো রূপভেদ বা প্রকার আছে- পয়ার, মহাপয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, দিগক্ষরা, একাবলী, সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ। নিচে এগুলোর সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হল-
দিগক্ষরা ছন্দ:  

ছন্দবদ্ধ কবিতার যে ছন্দ রীতিতে কবিতার প্রতিটি ছত্রেই দশটি করে বর্ণ থাকে এবং দশটি বর্ণ বিশিষ্ট একেকটি ছত্রেই এক একটি চরণ নিষ্পন্ন হয় , এবং পর পর এইরূপ দুইটি ছত্রের বা চরণের অন্ত্যবর্ণে, অথবা প্রথম ছত্র বা চরণ ও তৃতীয় ছত্র বা চরণের অন্ত্যবর্ণে এবং দ্বিতীয় ছত্র বা চরণ ও চতুর্থ ছত্র বা চরণের অন্ত্যবর্ণে মিল রক্ষিত হয়, তাকে দিগক্ষরা ছন্দ বলে। উদাহরণ :

উদাহরণ ঃ

 --অক্ষয় কুমার বড়াল

তুচ্ছ শঙ্খসম এ হৃদয়
পড়িয়া সংসার-তীরে একা-প্রতি চক্রে আবর্তে রেখায়
কত জনমের স্মৃতি লেখা!
আসে যায় কেহ নাহি চায়
সবাই খুঁজিছে মুক্তামণি;
কে শুনিবে হৃদয় আমার
ধ্বনিছে কি অন্তরের ধ্বনি !
হে রমণীলওতুলে লও,
তোমাদের মঙ্গল-উৎসবে-একবার ওই গীতি-গানে
বেজে উঠি সুমঙ্গল রবে!
হে রথীহে মহারথীলও
একবার ফুৎকার’ সরোষে-বল-দৃপ্তপরস্ব-লোলুপ
মরে যাক এ বজ্র-নির্ঘোষে !
হে যোগীহে ঋষিহে পূজক,
তোমরা ফুৎকার’ একবার-আহুতি-প্রণতি-স্তুতি আগে
বহে আনি আশীর্বাদ-ভার!


কবি অক্ষয় কুমার ড়াল রচিত হৃদয়-শঙ্খ কবিতায় লক্ষ্য করুন, প্রতিটি ছত্র বা চরণে দশটি করে বর্ণ আছে। প্রথম ও তৃতীয় এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ ছত্রের বা চরণের অন্ত্যবর্ণে মিল আছে। যেমন-

তুচ্ছ শঙ্খসম এ হৃদয় (২+৪+১+৩)=১০                ……প্রথম ছত্র। অন্ত্যবর্ণ = য়
প্রতি চক্রে আবর্তে রেখায় (২+২+৩+৩)=১০          ……তৃতীয় ছত্র। অন্ত্যবর্ণ = য়
পড়িয়া সংসার-তীরে একা* (+++)=১০     ….. দ্বিতীয় ছত্র।অন্ত্যবর্ণ = কা
কত জনমের স্মৃতি লেখা (+++)=১০          ……চতুর্থ ছত্র।অন্ত্যবর্ণ = খা

*সংসার শব্দের অনুস্বারকে বর্ণ হিসাবে গণনা করা হয় নাই।
সনেট :
• বাংলা ভাষায় প্রথম সনেট রচনা করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
• বাংলায় উল্লেখযোগ্য সনেট রচয়িতা- মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, অক্ষয়কুমার বড়াল, ফররুখ আহমদ,কামিনী রায়, প্রমুখ
• ১৪ বা ১৮ মাত্রার চরণ হয়
• দুই স্তবকে ১৪টি চরণ থাকে
• সাধারণত দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮টি ও ৬টি চরণ থাকে (চরণ বিন্যাসে ব্যতিক্রম থাকতে পারে)
• প্রথম আটটি চরণের স্তবককে অষ্টক ও শেষ ৬টি চরণের স্তবককে ষটক বলে
• এছাড়া সনেটের অন্ত্যমিল ও ভাবের মিল আছে এমন চারটি চরণকে একত্রে চৌপদী, তিনটি পদকে ত্রিপদীকা বলে
• নির্দিষ্ট নিয়মে অন্ত্যমিল থাকে
• দুইটি স্তবকে যথাক্রমে ভাবের বিকাশ ও পরিণতি থাকতে হয়; ব্যাপারটাকে সহজে ব্যাখ্যা করতে গেলে তা অনেকটা এভাবে বলা যায়- প্রথম স্তবকে কোন সমস্যা বা ভাবের কথা বলা হয়, আর দ্বিতীয় স্তবকে সেই সমস্যার সমাধান বা পরিণতি বর্ণনা করা হয়
• সনেটের ভাষা মার্জিত এবং ভাব গভীর ও গম্ভীর হতে হয়
• সনেট মূলত ৩ প্রকার- পেত্রার্কীয় সনেট, শেক্সপীয়রীয় সনেট ও ফরাসি সনেট; এই ৩ রীতির সনেটের প্রধান পার্থক্য অন্ত্যমিলে। এছাড়া ভাব, বিষয় ও স্তবকের বিভাজনেও কিছু পার্থক্য আছে (তা ব্যাকরণের ছন্দ প্রকরণের আলোচ্য নয়)। নিচে ৩ প্রকার সনেটের অন্ত্যমিলের পার্থক্য দেখান হল-
পেত্রার্কীয় রীতি
ক+খ+খ+ক  ক+খ+খ+ক
চ+ছ+জ  চ+ছ+জ
শেক্সপীয়রীয় রীতি
ক+খ+ক+খ
গ+ঘ+গ+ঘ
চ+ছ+চ+ছ
জ+জ
ফরাসি রীতি
ক+খ+খ+ক  ক+খ+খ+ক
গ+গ  চ+ছ+চ+ছ
উদাহরণ-

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব ∣ বিবিধ রতন;- ∣∣  (৮+৬)        ক
তা সবে, (অবোধ আমি!) ∣ অবহেলা করি, ∣∣ (৮+৬)          খ
পর-ধন-লোভে মত্ত, ∣ করিনু ভ্রমণ ∣∣ (৮+৬)            ক
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি ∣ কুক্ষণে আচরি। ∣∣ (৮+৬)                খ    অষ্টক
কাটাইনু বহু দিন ∣ সুখ পরিহরি। ∣∣ (৮+৬)             খ
অনিদ্রায়, অনাহারে ∣ সঁপি কায়, মনঃ, ∣∣ (৮+৬)         ক
মজিনু বিফল তপে ∣ অবরেণ্যে বরি;- ∣∣ (৮+৬)               খ
কেলিনু শৈবালে, ভুলি ∣ কমল-কানন। ∣∣ (৮+৬)                ক

স্বপ্নে তব কুললক্ষ্মী ∣ কয়ে দিলা পরে,- ∣∣ (৮+৬)         গ
ওরে বাছা, মাতৃকোষে ∣ রতনের রাজি ∣∣, (৮+৬)         ঘ
এ ভিখারী-দশা তবে ∣ কেন তোর আজি? ∣∣ (৮+৬)       ঘ    ষটক
যা ফিরি, অজ্ঞান তুই, ∣ যা রে ফিরি ঘরে। ∣∣ (৮+৬)           গ
পালিলাম আজ্ঞা সুখে; ∣ পাইলাম কালে ∣∣ (৮+৬)         ঙ
মাতৃভাষা-রূপ খনি, ∣ পূর্ণ মণিজালে । ∣∣। (৮+৬)        ঙ
                (বঙ্গভাষা; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

কবিতাটিতে দুই স্তবকে যথাক্রমে ৮ ও ৬ চরণ নিয়ে মোট ১৪টি চরণ আছে। প্রতিটি চরণে ৮ ও ৬ মাত্রার দুই পর্ব মিলে মোট ১৪ মাত্রা আছে।

অমিত্রাক্ষর ছন্দ :
• বাংলা ভাষায় অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন- মাইকেল মধুসূদন দত্ত
• অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান বৈশিষ্ট্য ভাবের প্রবহমানতা; অর্থাৎ, এই ছন্দে ভাব চরণ-অনুসারী নয়, কবিকে একটি চরণে একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করতেই হবে- তা নয়, বরং ভাব এক চরণ থেকে আরেক চরণে প্রবহমান এবং চরণের মাঝেও বাক্য শেষ হতে পারে
• বিরামচিহ্নের স্বাধীনতা বা যেখানে যেই বিরামচিহ্ন প্রয়োজন, তা ব্যবহার করা এই ছন্দের একটি বৈশিষ্ট্য
• অমিত্রাক্ষর ছন্দে অন্ত্যমিল থাকে না, বা চরণের শেষে কোন মিত্রাক্ষর বা মিল থাকে না
• মিল না থাকলেও এই ছন্দে প্রতি চরণে মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ১৪) এবং পর্বেও মাত্রা সংখ্যা নির্দিষ্ট (সাধারণত ৮++৬)
উদাহরণ-

                     তথা
জাগে রথ, রথী, গজ, ∣ অশ্ব, পদাতিক ∣∣  (৮+৬)
অগণ্য। দেখিলা রাজা ∣ নগর বাহিরে, ∣∣  (৮+৬)
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ ∣ সিন্ধুতীরে যথা, ∣∣  (৮+৬)
নক্ষত্র-মণ্ডল কিংবা ∣ আকাশ-মণ্ডলে। ∣∣  (৮+৬)
                     (মেঘনাদবধকাব্য; মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

এখানে কোন চরণের শেষেই অন্ত্যমিল নেই। আবার প্রথম বাক্যটি চরণের শেষে সমাপ্ত না হয়ে প্রবাহিত হয়ে একটি চরণের শুরুতেই সমাপ্ত হয়েছে (তথা জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক অগণ্য)। এই অন্ত্যমিল না থাকা এবং ভাবের বা বাক্যের প্রবহমানতাই অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রধান দুইটি বৈশিষ্ট্য।

গদ্যছন্দ :
• এই ছন্দে বাংলায় প্রথম যারা কবিতা লিখেছিলেন তাদের অন্যতম- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
• মূলত ফরাসি বিপ্লবের পরবর্তী শিল্পমুক্তির আন্দোলনের ফসল হিসেবে এর জন্ম
• গদ্য ছন্দ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- গদ্যের মধ্যে যখন পদ্যের রঙ ধরানো হয় তখন গদ্যকবিতার জন্ম হয়
• পর্বগুলো নানা মাত্রার হয়, সাধারণত পর্ব-দৈর্ঘ্যে কোন ধরনের সমতা বা মিল থাকে না
• পদ ও চরণ যতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন দ্বারা নির্ধারিত হয়; এই বিরাম চিহ্ন বা ছেদ চিহ্ন উচ্চারণের সুবিধার্থে নয়, বরং অর্থ প্রকাশের সুবিধার্থে ব্যবহৃত হয়
• গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও তা পড়ার সময় এক ধরনের ছন্দ বা সুরের আভাস পাওয়া যায়
• গদ্যকবিতা গদ্যে লেখা হলেও এর পদবিন্যাস কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ও পুনর্বিন্যাসিত হতে হয়
উদাহরণ-
১।। ‘সূর্যদেব’ তোমার বামে এই সন্ধ্যা, তোমার দক্ষিণে ঐ প্রভাত, এদের তুমি মিলিয়ে দাও৷
 এর ছায়া ওর আলোটিকে একবার কোলে তুলে নিয়ে চুম্বন করুক,
 এর পূরবী ওর বিভাসকে আশীর্বাদ করে চলে যাক৷’ (সন্ধ্যা ও প্রভাত)
২।। ‘যখন ঝিলীর ঝংকারে বেণুবনের অন্ধকার থর থর করছে যখন বাদল হাওয়ার দীপশিখা কেঁপে কেঁপে নিবে গেল, তখন সে তার অতি কাছের ঐ সংসারটাকে ছেড়ে দিয়ে আসুক ভিজে ঘাসের গন্ধেভরা বনপথ দিয়ে, আমার নিভৃত হূদয়ের নিশীথরাত্রে৷’ 
(মেঘদূত, ৫)
এই দুটি অংশই টানা গদ্যে লেখা৷ পদ্যের কোন ভাষা-রীতি এখানে নেই, ‘সাধারণ গদ্যের গদ্যধার্মিতাও নেই৷’ ছান্দসিক রামবহাল তেওরারী তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও হিন্দি ছন্দ’ গ্রন্থে গদ্য কবিতার তিনটি অপরিহার্য বিশেষত্বের কথা উলেখ করেছেন : 
১. শব্দধ্বনির গতি ও যতির আবর্তনের প্রত্যাশা বোধের তৃপ্তি 
২. ভাবের প্রত্যশিত স্পন্দমানতা 
৩. বাক্পর্বের প্রত্যাশিত বিন্যাস এবং শিল্পিত গদ্য৷
‘লিপিকা’র গদ্যকবিতা, পদ্যের মতো ভাবানুযায়ী খণ্ডিত পদে বিন্যস্তহয়নি, ‘পুনশ্চ’ কাব্যের (১৯৩২) ভূমিকায় সেই কৈফিয়তই কবি দিয়েছেন এভাবে ‘বোধ হয় ভীরুতাই তার কারণ৷’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন