শিবরাত্রি
ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীতে মহা শিবরাত্রির ব্রত পালন করা হয়। পুরাণ অনুসারে ভক্তি ও নিষ্ঠার সঙ্গে শিবরাত্রি পালন করলে রজোঃগুণ ও তমঃগুণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মহা শিবরাত্রির রাতে সোমনাথ, মল্লিকার্জুন, মহাকালেশ্বর, ওঙ্কারেশ্বর,কেদারনাথ, ভিমশঙ্কর,বিশ্বেশ্বর,ত্র্যম্বকেশ্বর, বৈদ্যনাথ, নাগেশ্বর, রামেশ্বর এবং ঘুশ্মেশ্বর - - এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ সেজে ওঠে। যথাবিহিত মর্যাদাসহকারে এই দিন শিবরাত্রির ব্রত উদযাপিত হয়।
শিবরাত্রি ব্রতের প্রয়োজনীয় দ্রব্য : –
সিদ্ধি, তিল, হরিতকী, ফুল, দূর্ব্বা, ধুতরাফুল, বিল্বপত্র, ধূপ, দীপ, ধুনা, দধি, দুগ্ধ, ঘৃত, চিনি, মধু, শিবের ধুতি ১, দূর্গার শাটী ১, আসনাঙ্গুরীয়ক ২, মধুপর্কের বাটী ২, নৈবেদ্য ৮, কুচা নৈবেদ্য ১, যথাসাধ্য পুরোহিত দক্ষিণা।
আরো পড়ুন:-
দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ
শিবস্তুতি
উমর-বিন-হাসনান দ্বারা স্তোত্রম
শিবমহিম্ন স্তোত্র
ব্রতের নিয়ম :-
শিবরাত্রির আগের দিন হবিষ্যান্ন গ্রহন করে রাতে বিছানায় না শুয়ে খড় বা কম্বলে শুতে হয়। ব্রতের দিন উপবাসী থেকে গঙ্গামাটি দিয়ে চারটি শিব গড়ে চার প্রহরে একটি করে শিবের পুজা করতে হয়। প্রতিষ্ঠিত শিব থাকলে তাতেই পুজা করতে হয় চার প্রহরে চার বার। প্রথম প্রহরে দুগ্ধ দ্বারা, দ্বিতীয় প্রহরে দধি দিয়ে, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত দিয়ে ও চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে স্নান করাতে হয়। সেদিন সারারাত্রি জাগরণ করে পরদিন ব্রতকথা শুনে, ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে ও সাধ্যমত দক্ষিণা দান করে পারণ করতে হয়।
ব্রতের ফলঃ-
একাধারে তিনি পঞ্চানন, তাঁর পাঁচটি আনন বা মুখ, আর তিনটি নয়ন। যেটি কপালে থাকে,সেই নয়নটি গ্যানের নয়ন।তিনি ব্রমহান্দের সৃষ্টি কর্তা,জীবের নিওয়ান্তা।তিনি স্বয়ম্ভু।তিনি আবার ধ্বংসে র অধিকর্তা।এঁর প্রধান অস্ত্র ত্রিশুল। মহাপ্রলয়ে কালে ইনি ডমরু বাজিয়ে ধ্বংসের সূচনা করেন।তিনি মহাযোগী সন্ন্যাসী,সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, নির্গুণ ধ্যানের প্রতীক।
মহাদেব বলেন, "ব্রতপালনকারী ত্রয়োদশীতে স্নান করে সংযম পালন করবে। স্বপক্ষ নিরামিষ বা হবিষ্যান্ন ভোজন করবে। ভূমি বা বালি বিছানো যজ্ঞবেদী অথবা কুশ বিছিয়ে শয়ন করে আমার নাম স্মরণ করতে থাকবে। রাত্রি শেষ হলে শয্যা ত্যাগ করে প্রাতঃ ক্রিয়াদি করবে অন্যান্য আবশ্যক কার্যাদি করবে। সন্ধ্যায় যথাবিধি পূজাদি করে বিল্বপত্র সংগ্রহ করবে। তারপর নিত্যক্রিয়াদি করবে। অতঃপর বিল্বপত্র দিয়ে আমার পূজা করবে। একটি বিল্বপত্র দ্বারা পূজা করলে আমার যে প্রীতি জন্মে, সকল প্রকার পুষ্প একত্র করে কিংবা মণি, মুক্তা, প্রবাল বা স্বর্ণনির্মিত পুষ্প দিয়ে আমার পূজা করলেও, আমার তার সমান প্রীতি জন্মে না। প্রহরে প্রহরে বিশেষভাবে স্নান করিয়ে আমার পূজা করবে। পুষ্প, গন্ধ, ধূপাদি দ্বার যথোচিত অর্চনা করবে। প্রথম প্রহরে দুগ্ধ, দ্বিতীয় প্রহরে দধি, তৃতীয় প্রহরে ঘৃত এবং চতুর্থ প্রহরে মধু দিয়ে আমাকে স্নান করাবে এবং পূজা করবে। এছাড়া যথাশক্তি নৃত্যগীতাদি দ্বারা আমার প্রীতি সম্পাদন করবে।"
হে দেবী, এই হলো আমার প্রীতিকর ব্রত। এ ব্রত করলে অপস্যা ও যজ্ঞের পূণ্য লাভ হয় এবং ষোল কলায় দক্ষতা জন্মে। এ ব্রতের প্রভাবে সিদ্ধি লাভ হয়। অভিলাষী ব্যক্তি সপ্তদীপা পৃথিবীর অধীশ্বর হয়।যজ্ঞের মধ্যে যেমন অশ্বমেধ যজ্ঞ , তীর্থের মধ্যে যেমন যেমন গঙ্গা , তেমনি ব্রতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রত হল শিব চতুর্দশী ব্রত। শিব চতুর্দশী ব্রত পালন করলে ধর্ম, অর্থ , কাম , মোক্ষ চতুর্বিধ ফল লাভ হয়ে থাকে।
এই ব্রত পালণের মন্ত্র-
সংসার ক্লেশদগ্ধস্য ব্রতেনানেন শঙ্কর। প্রসীদ, সুমুখো নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদ ভব।।
ॐ নমঃ শিবায় ( তিন বার)
** দ্বিজাতি ভিন্ন অন্যেরা ॐ উচ্চারণ করবেন না।
ব্রতকথা :-
একবার কৈলাশশিখরে শিব ও পার্বতী নির্জনে গল্প করছিলেন । কথা প্রসঙ্গে পার্বতী শিবকে প্রশ্ন করলেন, "ভগবান, আপনি ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের দাতা। আপনি কোন ব্রত বা তপস্যায় সন্তুষ্ট হন ?" দেবী পার্বতীর কথা শুনে শিব বললেন, "হে দেবী, ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথীর রাত্রিকে মহা শিবরাত্রি বলা হয়। এই রাত্রিতে উপবাস করলে আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট হই। স্নান, বস্ত্র, ধূপ, পুষ্প ও অর্চনায় আমি যতটুকু সন্তুষ্ট হই তার চেয়ে বেশি সন্তুষ্ট হই শিবরাত্রির উপবাসে।"
শিব পার্বতীকে আরও বলেন, এবার শিবচতুদর্শী তিথির মাহাত্ম্য বলছি, শোন।
একবার বারাণসীতে ভয়ঙ্কর এক ব্যাধ জন্ম নিয়েছিল । নিষ্ঠুর সেই ব্যাধ ফাঁদ, জাল, দড়ির ফাঁস ইত্যাদি সহকারে প্রাণীদের হত্যা করত।
একদিন সে বনে গিয়ে অনেক পশু হত্যা করল। তারপর নিহত পশুদের মাংসভার নিয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো। পথে শ্রান্ত হয়ে সে বনের মধ্যে বিশ্রামের জন্য একটি বৃক্ষমূলে শয়ন করলো এবং একটু পরেই নিদ্রিত হলো।
রাত্রকালে ব্যাধ জেগে উঠল। ঘোর অন্ধকারে কোনো কিছুই কারও দৃষ্টিগোচর হলো না। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে একটি শ্রীফলবৃক্ষ অর্থাৎ বিল্ববৃক্ষ পেল। সেই বিল্ববৃক্ষে সে লতা দিয়ে তার মাংসভার বেঁধে রাখল। বৃক্ষতলে হিংশ্র জন্তুর ভয় আছে। এই ভেবে সে নিজেও ঐ বিল্ববৃক্ষে উঠে পড়ল। শীতে ও ক্ষুধায় তার শরীর কাঁপতে লাগল। এভাবে সে শিশিরে ভিজেই জেগে কাটাল সারা রাত।
দৈববশত সেই বিল্ববৃক্ষমূলে ছিল আমার (অর্থাৎ শিবের) একটি প্রতীক। তিথিটি ছিল শিবচতুর্দশী। আর ব্যাধও সেই রাত্রি কাটিয়েছিল উপবাসে। তার শরীর থেকে আমার প্রতীকের ওপর হিম বা শিশির ঝরে পড়েছিল। তার শরীরের ঝাঁকুনিতে বিল্বপত্র পড়েছিল আমার প্রতীকের ওপর। এভাবে উপবাসে বিল্বপত্র প্রদানে এবং শিশিরস্নানে নিজের অজান্তেই ব্যাধ শিবরাত্রিব্রত করে ফেলল। দেবী, তিথিমাহাত্মে কেবল বিল্বপত্রে আমার যে প্রীতি হয়েছিল, স্নান, পূজা বা নৈবেদ্যদি দিয়েও সে প্রীতি সম্পাদন সম্ভব নয়। তিথি মাহাত্মে ব্যাধ মহাপূণ্য লাভ করেছিল। পরদিন উজ্জল প্রভাতে ব্যাধ নিজের বাড়িতে চলে গেল।
কালক্রমে ব্যাধের আয়ু শেষ হলো। যমদূত তার আত্মাকে নিতে এসে তাকে যথারীতি যমপাশে বেঁধে ফেলতে উদ্যত হলো। অন্যদিকে আমার প্রেরিত দূত ব্যাধকে শিবলোকে নিয়ে এল। আর আমার দূতের দ্বারা আহত হয়ে যমদূত যমরাজকে নিয়ে আমার পুরদ্বারে উপস্থিত হলো। দ্বারে শিবের অনুচর নন্দীকে দেখে যম তাকে সব ঘটনা বললেন। এই ব্যাধ সারা জীবন ধরে কুকর্ম করেছে। জানালেন যম।
তার কথা শুনে নন্দী বললেন, ধর্মরাজ, এতে কোনো সন্দেহই নেই যে ঐ ব্যাধ দুরাত্মা। সে সারা জীবন অবশ্যই পাপ করেছে। কিন্তু শিবরাত্রি ব্রতের মাহাত্মে সে পাপমুক্ত হয়েছে এবং সর্বেশ্বর শিবের কৃপা লাভ করে শিবলোকে এসেছে।
নন্দীর কথা শুনে বিস্মিত হলেন ধর্মরাজ। তিনি শিবের মাহাত্মর কথা ভাবতে ভাবতে যমপুরীতে চলে গেল। শিব পার্বতীকে আরও বলেলেন, এই হলো শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম। শিবের কথা শুনে শিবজায়া হিমালয় কন্যা পার্বতী বিস্মিত হলেন। তিথি শিবরাত্রিব্রতের মাহাত্ম্য নিকটজনের কাছে বর্ণনা করলেন। তারা আবার তা ভক্তি ভরে জানালেন পৃথিবীর বিভিন্ন রাজাকে। এভাবে শিবরাত্রিব্রত পৃথিবীতে প্রচলিত হলো।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন