দোলযাত্রা বা হোলি
হোলি বা দোলযাত্রা হল হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মের একটি অন্যতম প্রধান উৎসব। এটি একাধারে রঙের উৎসব ও প্রেমের উৎসব প্রধানত ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে হোলি বা দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। নারদ পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ ও ‘জৈমিনি মীমাংসা’য় রঙের উৎসবের বিবরণ পাওয়া যায়। হর্ষবর্ধনের নাটক ‘রত্মাবলী’তে ও সপ্তম শতাব্দীর এক শিলালিপিতে রাজা হর্ষবর্ধন কর্তৃক ‘হোলিকোৎসব’ পালনের উল্লেখ পাওয়া যায়।
হোলির প্রথম সন্ধ্যাকে বলে ছোট হোলি। এদিন হোলিকা দহন বা মেড়াপোড়া অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিনকে বলা হয় ফাগুয়া, ধুলেন্দি বা রঙ্গোলি হোলি।
হোলিকে নেপালি ও হিন্দিতে होली (হোলি ) , মারাঠিতে होळी,পাঞ্জাবীতে ਹੋਲੀ, কানাড়ায় ಹೋಳಿ, তেলেগুতে హోళి, অসমীয়া ভাষায় ফাকুৱা ও দ’ল যাত্ৰা , ওড়িয়ায় ଦୋଳଯାତ୍ରା (দোলযাত্রা ), আর বাংলাভাষার দোলযাত্রা বলে।
হোলি উৎসবের সূচনা :-
১।। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়। হোলি নামটা এসেছে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার নাম থেকে । হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর বোন । হিরণ্যকশিপু ছিলেন অপরাজেয়। তাই সে নিজেকে ভগবান হিসেবে ঘোষণা করেন । আরো ঘোষণা করেন যে তাই কোনও দেবতাকে নয়, পুজো তাকেই করতে হবে। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সে তার বাবার আদেশ মানতে রাজি নয়। হিরণ্যকশিপু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নানা ভাবে ছেলেকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ফল হল না। শেষে প্রহ্লাদকে ভুলিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসল হোলিকা। হোলিকার ছিল অগ্নিনিরোধক শাল । নিজে গায়ে দিল সেই অগ্নি-নিরোধক শাল। কিন্তু আগুন জ্বলে উঠতেই সেই শাল উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদকে ঢেকে ফেলল। অগ্নিদগ্ধ হল হোলিকা। ওই আগুন হল অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের প্রতীক।একে আমরা প্রতীকীভাবে প্রকাশ করি চাঁচর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে। আমরা বলি চাঁচর বা মেড়াপোড়া। ওড়িশায় একই বলে মেন্টপোড়াই। হোলিকা দগ্ধ হওয়ার পরের দিন পালিত হয় হোলি।
২।। শৈব মতানুসারে এদিনে ভগবান শিব মদনকে দগ্ধ করেন তাই এই দিনটি কামপঞ্চমী বা বসন্তপঞ্চমী হিসাবে পালন করা হয়।মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করতে মদন পুষ্পধনুতে শরসন্ধান করে দেবাদিদেবকে বিদ্ধ করলেন। মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ হল বটে কিন্তু রুষ্ট শঙ্করের তৃতীয় নয়নের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন মদনদেব। মদনের স্ত্রী রতি শিবের পায়ের উপর পড়ে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। তাতে মহাদেবের হৃদয় একটু নরম হল। দেহ আর ফিরে পেলেন না মদন। তিনি রয়ে গেলেন অনঙ্গ হয়ে। এটিকে স্মরণ করেই দক্ষিণ ভারতে হোলির সময় ‘কামদহনম’ বা ‘কামাহন’ উৎসব পালিত হয়।
৩।। দ্বাপরযুগে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে ( মতান্তরে অরিষ্টাসুরকে ) বধ করেন। অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর সকলে আনন্দে রঙের উৎসব পালন করে।
৪।। বৈষ্ণবমত অনুসারে ফাল্গুনীপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সাথে আবির বা গুলাল নিয়ে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়।
৫।। স্কন্দপুরাণের একটি অধ্যায়ে দোলযাত্রার কথা বলা হয়েছে। যুধিষ্ঠির দোলযাত্রার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, সত্যযুগে রঘু নামে এক ধার্মিক ও গুণবান রাজা ছিলেন। তাঁর রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি, মহামারী বা অকালমৃত্যু বলে কিছু ছিল না। কিন্তু একবার ঢুনঢা নামে এক রাক্ষসীর প্রভাবে রাজ্যে নানা অমঙ্গল সূচিত হয়। নানা রোগে ভুগে ভুগে মানুষের মৃত্যু হতে থাকে। প্রজারা বিপদ দেখে রাজার শরণাপন্ন হলেন। রাজা সব কথা শুনে ডেকে পাঠালেন প্রধান পুরোহিতকে। পুরোহিত এসে গণনা করে রাজাকে বললেন, পুরাকালে মালিনীর কন্যা ঢুনঢা কঠোর তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করেন। শিব তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললে ঢুনঢা অমরত্ব বর প্রার্থনা করে। শিব তাঁকে বরদান করে বলেন, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে তাঁকে কেউ বধ করতে পারবে না। শুধু ঋতু পরিবর্তনের সময় উন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তি বা বালকগণের কাছ থেকে তাঁকে দূরে থাকতে হবে। পুরোহিতের কাছ থেকে মৃত্যুর পন্থা জানতে পেরে রাজ্যের বালকরা সবাই একত্রিত হয়ে শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে রাক্ষসী ঢুনঢাকে পুড়িয়ে মারে। হোলিকা, পুতনা, ঢুনঢা এরা সবাই অশুভের প্রতীক। একদিকে যেমন শীতের অবসানে বসন্তের আগমন হয়। তেমনই ফেলে আসা শীতের ঝরাপাতা, শুকনো আবর্জনাকে পুড়িয়ে ফেলে নতুন রংয়ে নিজেদের মনকে রাঙিয়ে তোলার উৎসব দোল।
৬।। শুধু হোলিকা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুতনা রাক্ষসীর কাহিনিও। কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য পুতনা রাক্ষসীকে পাঠিয়েছিল রাজা কংস। পুতনার বুকের বিষদুধ পান করে যাতে মৃত্যু হয় কৃষ্ণের। কিন্তু কৃষ্ণের মরণ কামড়ে মৃত্যু হল পুতনার। এরপর গোপবালকেরা সেই রাক্ষসীর প্রতিকৃতি আগুনে পুড়িয়ে উৎসব পালন করে। এখানেও তো আমরা দেখি সেই দুষ্টের দমনের স্মরক।
৭।। এই দোলপূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মনিয়েছিলেন বলে একে গৌরপূর্ণিমা বলা হয়।শ্রীচৈতন্য বৃন্দাবনের হোরিখেলার অনুকরণে বাংলাতেও দোলযাত্রার সূচনা করেছিলেন। তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে আবির ও রং দেওয়ার মাধ্যমে নিজের মনের শুভ রংটি দেবতার কাছে সমর্পণ করার তত্ত্বকে তুলে ধরেন । সেই রংই মনের শুদ্ধ ভক্তির প্রতীক হয়ে যায়।
৮।। শিখ গুরু গোবিন্দ সিং তিনদিনের হোলা মহল্লা পালন শুরু করেন।
৯।। রাজা রণজিৎ সিং রাধাকৃষ্ণের পটচিত্র সামনে রেখে হোলি পালন করতেন।
১০।। এই উৎসবে ফাগুনের রঙিন আনন্দের ঘোর লাগে মানুষের দেহে ও মনে।
ধর্ম ও পুরাণের জীবন থেকে রংয়ের উৎসব নেমে এল ইতিহাসের সরণি বেয়ে আমাদের আজকের জীবনে। ইতিহাসের পাতাতেও হোলিখেলার বহু কাহিনি পাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘হোরিখেলা’র উল্লেখ করা যেতে পারে। পাঠান বীর কেসর খাঁকে হোরি খেলতে আমন্ত্রণ জানালেন ভুনাগ রানি। দোলকে কেন্দ্র করে সে এক রাজনৈতিক লড়াই। প্রতিশোধের রংয়ে রাঙা হল মাটি।
ইতিহাসে প্রথম হোলির উল্লেখ পাই আমরা বাণভট্টের রত্নাবলী নাটকে। সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের সময় লেখা এই নাটকে হোলি উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়। একাদশ শতাব্দীতে পর্যটক আলবেরুণী এসেছিলেন ভারত ভ্রমণে। তাঁর লেখায় হোলির বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘আইনি আকবরী’তে বলা হয়েছে তখন কেবল শূদ্ররাই হোলি খেলত। অবশ্য সেই অর্থে সম্প্রদায়গত বিভেদ বলে একসময় কিছু ছিল না। তখন সব উৎসবে এদেশে সবাই মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যেতেন। তখন মুসলমানরাও রং-আবির খেলায় যোগ দিতেন। সেই রং পৌঁছে গিয়েছিল রাজদরবারেও। আবির-গুলাল উড়ত প্রাসাদের বাগানে, অলিন্দে। দোল নিয়ে লেখা হতো কবিতা আর বসত গানের আসর। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম তাঁর দরবারে হোলি খেলতেন। ফাগের সঙ্গে ছড়ানো হত গোলাপ জল। হোলি নিয়ে নিজেও বেশ কয়েকটি দিওয়ান বা কবিতা ও গান লিখেছিলেন। সেই গান তিনি দরবারে বসে শুনতেন। হোলির দিন বসত কাওয়ালির আসর। আর প্রাসাদের ভিতরে তাঁর বালক পুত্র সুলেমান শুকোহ কৃষ্ণ সেজে অন্যদের সঙ্গে হোলি খেলত। সেই সময়কার লেখা বইতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন বইতে পাওয়া যায় আওধের রাজাদের হোলি খেলারও প্রসঙ্গ। আওধের রাজদরবারে হোলি খেলা নিয়ে লিখে গিয়েছেন উর্দু কবি মির তাকি মির। হোলি খেলার সময় রাধাকৃষ্ণ সাজিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হতো। এছাড়া বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌল্লা আবির খেলতে ভালোবাসতেন বলে শোনা যায়।
শান্তিনিকেতনে দোলযাত্রা :-
শান্তিনিকেতনে প্রভাতফেরীর মাধ্যমে দোলউৎসব আরম্ভ হয়। 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল..' গানের মাধ্যমে প্রভাতফেরী হয়। একে বসন্তোৎসবও বলা হয়। রবিন্দ্রসঙ্গীত ও রবিন্দ্রনৃত্যের মাধ্যমে দোলউৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। রবি ঠাকুর ১৯২৫ সালে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
রীতিনীতি :-
দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়।শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা স্তুপ করে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয় ।
দোলযাত্রার দিন সকালে তাই ভগবান শ্রীরাম ও সীতা বা রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে রাঙিয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন।
ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে সিদ্ধি ও ভাঙের সরবত বা লাড্ডু খেয়ে লোকেরা হোলিতে মাতে।
ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, রাশিয়া, ফিজি, কানাডা, মরিশাস, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে ইস্কন প্রভৃতি হিন্দু সংগঠনের উদ্যোগে বিপুল সংখ্যক মানুষ হোলি পালন করেন।
হোলির প্রথম সন্ধ্যাকে বলে ছোট হোলি। এদিন হোলিকা দহন বা মেড়াপোড়া অনুষ্ঠিত হয়। পরের দিনকে বলা হয় ফাগুয়া, ধুলেন্দি বা রঙ্গোলি হোলি।
হোলিকে নেপালি ও হিন্দিতে होली (হোলি ) , মারাঠিতে होळी,পাঞ্জাবীতে ਹੋਲੀ, কানাড়ায় ಹೋಳಿ, তেলেগুতে హోళి, অসমীয়া ভাষায় ফাকুৱা ও দ’ল যাত্ৰা , ওড়িয়ায় ଦୋଳଯାତ୍ରା (দোলযাত্রা ), আর বাংলাভাষার দোলযাত্রা বলে।
হোলি উৎসবের সূচনা :-
১।। উত্তর ভারতে হোলি উৎসবটি বাংলার দোলযাত্রার পরদিন পালিত হয়। হোলি নামটা এসেছে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকার নাম থেকে । হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর বোন । হিরণ্যকশিপু ছিলেন অপরাজেয়। তাই সে নিজেকে ভগবান হিসেবে ঘোষণা করেন । আরো ঘোষণা করেন যে তাই কোনও দেবতাকে নয়, পুজো তাকেই করতে হবে। কিন্তু হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। সে তার বাবার আদেশ মানতে রাজি নয়। হিরণ্যকশিপু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। নানা ভাবে ছেলেকে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু ফল হল না। শেষে প্রহ্লাদকে ভুলিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসল হোলিকা। হোলিকার ছিল অগ্নিনিরোধক শাল । নিজে গায়ে দিল সেই অগ্নি-নিরোধক শাল। কিন্তু আগুন জ্বলে উঠতেই সেই শাল উড়ে গিয়ে প্রহ্লাদকে ঢেকে ফেলল। অগ্নিদগ্ধ হল হোলিকা। ওই আগুন হল অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়ের প্রতীক।একে আমরা প্রতীকীভাবে প্রকাশ করি চাঁচর পোড়ানোর মধ্য দিয়ে। আমরা বলি চাঁচর বা মেড়াপোড়া। ওড়িশায় একই বলে মেন্টপোড়াই। হোলিকা দগ্ধ হওয়ার পরের দিন পালিত হয় হোলি।
২।। শৈব মতানুসারে এদিনে ভগবান শিব মদনকে দগ্ধ করেন তাই এই দিনটি কামপঞ্চমী বা বসন্তপঞ্চমী হিসাবে পালন করা হয়।মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ করতে মদন পুষ্পধনুতে শরসন্ধান করে দেবাদিদেবকে বিদ্ধ করলেন। মহাদেবের ধ্যানভঙ্গ হল বটে কিন্তু রুষ্ট শঙ্করের তৃতীয় নয়নের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন মদনদেব। মদনের স্ত্রী রতি শিবের পায়ের উপর পড়ে স্বামীর প্রাণভিক্ষা চাইলেন। তাতে মহাদেবের হৃদয় একটু নরম হল। দেহ আর ফিরে পেলেন না মদন। তিনি রয়ে গেলেন অনঙ্গ হয়ে। এটিকে স্মরণ করেই দক্ষিণ ভারতে হোলির সময় ‘কামদহনম’ বা ‘কামাহন’ উৎসব পালিত হয়।
৩।। দ্বাপরযুগে বসন্তপূর্ণিমার এই দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কেশি নামক অসুরকে ( মতান্তরে অরিষ্টাসুরকে ) বধ করেন। অত্যাচারী এই অসুরকে বধ করার পর সকলে আনন্দে রঙের উৎসব পালন করে।
৪।। বৈষ্ণবমত অনুসারে ফাল্গুনীপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ রাধিকা ও অন্যান্য গোপীগণের সাথে আবির বা গুলাল নিয়ে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়।
৫।। স্কন্দপুরাণের একটি অধ্যায়ে দোলযাত্রার কথা বলা হয়েছে। যুধিষ্ঠির দোলযাত্রার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন, সত্যযুগে রঘু নামে এক ধার্মিক ও গুণবান রাজা ছিলেন। তাঁর রাজ্যে দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি, মহামারী বা অকালমৃত্যু বলে কিছু ছিল না। কিন্তু একবার ঢুনঢা নামে এক রাক্ষসীর প্রভাবে রাজ্যে নানা অমঙ্গল সূচিত হয়। নানা রোগে ভুগে ভুগে মানুষের মৃত্যু হতে থাকে। প্রজারা বিপদ দেখে রাজার শরণাপন্ন হলেন। রাজা সব কথা শুনে ডেকে পাঠালেন প্রধান পুরোহিতকে। পুরোহিত এসে গণনা করে রাজাকে বললেন, পুরাকালে মালিনীর কন্যা ঢুনঢা কঠোর তপস্যা করে শিবকে তুষ্ট করেন। শিব তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললে ঢুনঢা অমরত্ব বর প্রার্থনা করে। শিব তাঁকে বরদান করে বলেন, স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে তাঁকে কেউ বধ করতে পারবে না। শুধু ঋতু পরিবর্তনের সময় উন্মাদগ্রস্ত ব্যক্তি বা বালকগণের কাছ থেকে তাঁকে দূরে থাকতে হবে। পুরোহিতের কাছ থেকে মৃত্যুর পন্থা জানতে পেরে রাজ্যের বালকরা সবাই একত্রিত হয়ে শুকনো কাঠ জ্বালিয়ে রাক্ষসী ঢুনঢাকে পুড়িয়ে মারে। হোলিকা, পুতনা, ঢুনঢা এরা সবাই অশুভের প্রতীক। একদিকে যেমন শীতের অবসানে বসন্তের আগমন হয়। তেমনই ফেলে আসা শীতের ঝরাপাতা, শুকনো আবর্জনাকে পুড়িয়ে ফেলে নতুন রংয়ে নিজেদের মনকে রাঙিয়ে তোলার উৎসব দোল।
৬।। শুধু হোলিকা নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পুতনা রাক্ষসীর কাহিনিও। কৃষ্ণকে হত্যা করার জন্য পুতনা রাক্ষসীকে পাঠিয়েছিল রাজা কংস। পুতনার বুকের বিষদুধ পান করে যাতে মৃত্যু হয় কৃষ্ণের। কিন্তু কৃষ্ণের মরণ কামড়ে মৃত্যু হল পুতনার। এরপর গোপবালকেরা সেই রাক্ষসীর প্রতিকৃতি আগুনে পুড়িয়ে উৎসব পালন করে। এখানেও তো আমরা দেখি সেই দুষ্টের দমনের স্মরক।
৮।। শিখ গুরু গোবিন্দ সিং তিনদিনের হোলা মহল্লা পালন শুরু করেন।
৯।। রাজা রণজিৎ সিং রাধাকৃষ্ণের পটচিত্র সামনে রেখে হোলি পালন করতেন।
১০।। এই উৎসবে ফাগুনের রঙিন আনন্দের ঘোর লাগে মানুষের দেহে ও মনে।
ধর্ম ও পুরাণের জীবন থেকে রংয়ের উৎসব নেমে এল ইতিহাসের সরণি বেয়ে আমাদের আজকের জীবনে। ইতিহাসের পাতাতেও হোলিখেলার বহু কাহিনি পাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত কবিতা ‘হোরিখেলা’র উল্লেখ করা যেতে পারে। পাঠান বীর কেসর খাঁকে হোরি খেলতে আমন্ত্রণ জানালেন ভুনাগ রানি। দোলকে কেন্দ্র করে সে এক রাজনৈতিক লড়াই। প্রতিশোধের রংয়ে রাঙা হল মাটি।
ইতিহাসে প্রথম হোলির উল্লেখ পাই আমরা বাণভট্টের রত্নাবলী নাটকে। সপ্তম শতকে হর্ষবর্ধনের সময় লেখা এই নাটকে হোলি উৎসবের বর্ণনা পাওয়া যায়। একাদশ শতাব্দীতে পর্যটক আলবেরুণী এসেছিলেন ভারত ভ্রমণে। তাঁর লেখায় হোলির বর্ণনা পাওয়া যায়। ‘আইনি আকবরী’তে বলা হয়েছে তখন কেবল শূদ্ররাই হোলি খেলত। অবশ্য সেই অর্থে সম্প্রদায়গত বিভেদ বলে একসময় কিছু ছিল না। তখন সব উৎসবে এদেশে সবাই মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যেতেন। তখন মুসলমানরাও রং-আবির খেলায় যোগ দিতেন। সেই রং পৌঁছে গিয়েছিল রাজদরবারেও। আবির-গুলাল উড়ত প্রাসাদের বাগানে, অলিন্দে। দোল নিয়ে লেখা হতো কবিতা আর বসত গানের আসর। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম তাঁর দরবারে হোলি খেলতেন। ফাগের সঙ্গে ছড়ানো হত গোলাপ জল। হোলি নিয়ে নিজেও বেশ কয়েকটি দিওয়ান বা কবিতা ও গান লিখেছিলেন। সেই গান তিনি দরবারে বসে শুনতেন। হোলির দিন বসত কাওয়ালির আসর। আর প্রাসাদের ভিতরে তাঁর বালক পুত্র সুলেমান শুকোহ কৃষ্ণ সেজে অন্যদের সঙ্গে হোলি খেলত। সেই সময়কার লেখা বইতে তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বিভিন্ন বইতে পাওয়া যায় আওধের রাজাদের হোলি খেলারও প্রসঙ্গ। আওধের রাজদরবারে হোলি খেলা নিয়ে লিখে গিয়েছেন উর্দু কবি মির তাকি মির। হোলি খেলার সময় রাধাকৃষ্ণ সাজিয়ে শোভাযাত্রা বের করা হতো। এছাড়া বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌল্লা আবির খেলতে ভালোবাসতেন বলে শোনা যায়।
শান্তিনিকেতনে দোলযাত্রা :-
শান্তিনিকেতনে প্রভাতফেরীর মাধ্যমে দোলউৎসব আরম্ভ হয়। 'ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল লাগলো যে দোল..' গানের মাধ্যমে প্রভাতফেরী হয়। একে বসন্তোৎসবও বলা হয়। রবিন্দ্রসঙ্গীত ও রবিন্দ্রনৃত্যের মাধ্যমে দোলউৎসব পালনের রীতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কাল থেকেই চলে আসছে। রবি ঠাকুর ১৯২৫ সালে এই উৎসবের উদ্বোধন করেন। এখনো সেই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
রীতিনীতি :-
দোলের পূর্বদিন খড়, কাঠ, বাঁশ ইত্যাদি জ্বালিয়ে এক বিশেষ বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয়।শুকনো গাছের ডাল, কাঠ ইত্যাদি দাহ্যবস্তু অনেক আগে থেকে সংগ্রহ করে সু-উচ্চ একতা স্তুপ করে তাতে অগ্নি সংযোগ করে ‘হোলিকা দহন’ হয় ।
দোলযাত্রার দিন সকালে তাই ভগবান শ্রীরাম ও সীতা বা রাধা ও কৃষ্ণের বিগ্রহ আবির ও গুলালে রাঙিয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রায় বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পর রং খেলেন।
ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চলে সিদ্ধি ও ভাঙের সরবত বা লাড্ডু খেয়ে লোকেরা হোলিতে মাতে।
ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও আমেরিকা, রাশিয়া, ফিজি, কানাডা, মরিশাস, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি দেশে ইস্কন প্রভৃতি হিন্দু সংগঠনের উদ্যোগে বিপুল সংখ্যক মানুষ হোলি পালন করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন