( আরও দেখুন -
সূচিপত্র )
দীপাবলীর উপলক্ষে পঞ্চোৎসব পালন করা হয়। এগুলি হল যথাক্রমে
ধনতেরাস ,
নরকচতুর্দশী , দীপাবলী,
গোবর্ধনপুজা ও ভাইফোঁটা । ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটা হল হিন্দু ক্যালেন্ডারের তুলারাশির শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় দিন। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে যমুনা তাঁর ভাই যমের মঙ্গল কামনায় এই ব্রত করেন। তাঁরই পুণ্যপ্রভাবে যমদেব অমরত্ব লাভ করেন। এই কাহিনীতে প্রেরিত হয়ে বর্তমান কালের বোনেরাও এই অচার পালন করে আসছেন ।
বিভিন্ন নাম:-
বাংলায় এই উৎসব ভাইফোঁটা নামে পরিচিত হলেও নেপালে এর নাম 'ভাইটিকা'। বিহার, উত্তরপ্রদেশ প্রভৃতি অবধি ও মৈথিলি ভাষাভাষী অঞ্চলে এই উৎসব 'ভাইয়াদুজ' নামে পরিচিত। মহারাষ্ট্র,গোয়া,গুজরাত, কর্ণাটক প্রভৃতি গুজরাটি, কোঙ্কনি ও মারাঠিভাষী আঞ্চলে এই উৎসবকে 'ভাউবীজ' বলে।
কাহিনী :-
ভাইফোঁটা উপলক্ষ্যে অনেক কাহিনীর প্রচলিত আছে। সেগুলি হল -
১।। ঋকবেদ অনুযায়ী, মৃত্যুদন্ডদাতা যম ও তাঁর বোন যমুনা হচ্ছে সূর্য্যের যমজ সন্তান, অর্থাৎ তারা যমজ ভাই বোন। বড় হয়ে তারা পরস্পর থেকে অনেক দূরে থাকতেন। দীর্ঘকাল অদর্শনে থেকে বোন যমুনার খুব ইচ্ছে হলো ভাই যমকে একটু দেখার। ভাইকে নিমন্ত্রণ করতেই ভাই যমরাজ বোনের বাড়ীতে এসে উপস্থিত। ভাইকে যথাসাধ্য আপ্যায়ন শেষে ভাইয়ের জন্য মন ব্যাকুল হতেই বোন যমুনা ভাইয়ের সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করে প্রার্থনা করেন, ভাই যমরাজ খুব প্রীত হন বোনের এই আকুলতা দেখে।
২।। নরকাসুরকে বধ করে শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকযয় ফিরে গেলে। সেখানে ক্লান্ত শ্রীকৃষ্ণকে বোন সুভদ্রা প্রদীপ জ্বালিয়ে অভ্যর্থনা করল। পিঁড়ি পেতে খেতে দিল কতরকমের সুস্বাদু খাবার । ভাই যেন পুনর্জন্ম পেল, অর্থাৎ হয়ে গেল দ্বিজ, তাই শুরু হল ভাই-দ্বিজ, অপভ্রংশে ভাইদুজ।
৩।। পুরাণ মতে দানবরাজ বলি পাতালে বামনরূপী ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক বন্দি হলে ভগবান বিষ্ণু বর দিতে চাইলে বলি বললেন, "প্রভূ , আপনি এখানেই দ্বারপাল হিসাবে থাকুন, যাতে আসতে যেতে আপনার দেখা পাই। ভগবান বিষ্ণু হলেন বলির দ্বারপাল । এদিকে স্বামীর জন্য বহুকাল অপেক্ষা করে মা লক্ষ্মী যান নারদের কাছে। সেখানে তিনি সবকিছু জানতে পারেন।
তখন পাতালে গিয়ে তিনি বলির সাথে ভাইবোনের সম্পর্ক স্থাপন করেন। বলির কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে বললেন , "ভাই আমার ! আজ থেকে তুমি আমার ভাই।" বলি বললো,"বোন, তোর কি চায় বল। যা চায় তাই পাবি।" লক্ষ্মী বলল, "আমার স্বামীকে আটকে রেখেছ, ছেড়ে দাও।" বলি তৎক্ষণাৎ ভগবান বিষ্ণুকে মুক্তি দিলেন।
৪।। জৈন ধর্ম অনুসারে রাজা নন্দীবর্ধন বহুদিন ভাইকে না দেখে মনোকষ্টে ভুগছে। ভাই মহাবীর তপস্যায় নির্বাণলাভ করে জৈনধর্ম প্রচার করে বেড়াচ্ছে। নন্দীবর্ধনের কষ্ট লাঘবের জন্যে বোন সুদর্শনা কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় ভায়ের বাড়ি এসে তার সেবা করতে লাগল। এই ঘটনাকে মনে রেখে জৈনরা ভাইফোঁটা পালন করেন।
৫।। ভাইফোঁটা নিয়ে আবার একটি লোককথা আছে। সেই গল্প অনুসারে, - -
একসময় একটা জঙ্গলের পাশে এক বাড়িতে এক পরিবার বাস করত । সেই বাড়ির ছেলেটির দিদির যখন বিয়ে হয় তখন সে খুব ছোট। বড় হয়ে দিদির কথা জানতে পেরে সে মাকে জিজ্ঞেস করে, "মা, আমারও তো দিদি আছে তুমি বলো, সে কেন আসে না?" মা বলে," তার শ্বশুরবাড়ি অনেক দূর, জঙ্গল, খরস্রোতা নদী পেরিয়ে সে কী করে আসবে ?"
ছেলেটি মায়ের কাছে বিদায় নিয়ে দিদির শ্বশুরবাড়ির দিকে চলে। জঙ্গলের পথে হাঁটছে ছেলে, ধেয়ে এল সাপ। ছেলে বলল, জানো, আমি আমার দিদির কাছে যাচ্ছি, কতদিন তাকে দেখিনি, এখন আমাকে কেটো না, প্লীজ, ফেরার পথে যা খুশি কোরো। সাপ বলল, ঠিক আছে। ছুটে এল বাঘ, তাকেও একই কথা বলল সে। পাহাড় শুরু করল তার ওপর পাথর ফেলতে, সে মিনতি করল, এখন আমায় মেরো না দয়া করে। ওরা মেনে নিল। নদী পার হতে গিয়ে দেখে প্রবল স্রোত, ভেসে যাবার উপক্রম। নদীর কাছেও সে চাইল তাকে যেন পার করে দেয়। নদী তাকে পার করে দেয় । ভাইকে পেয়ে তো দিদির আনন্দের শেষ নেই। খাওয়া-দাওয়া ফোঁটা-টোঁটা তো হলই, কত গল্পগুজব, খুনসুটি, কত কী! অনেক দিন সেখানে থেকে ফেরার যখন সময় হল, দিদি বলল, আবার আসিস ভাই। ভাই বলল, "জানিস দিদি, আমাদের আর দেখা হবে না।" আসার সময় যা যা কাণ্ড হয়েছিল, সব দিদিকে বলল সে।দিদি বলল, "কী, আমার ভাইকে মেরে ফেলবে এরা? রসো, মজা দ্যাখাচ্ছি।" সেও পোঁটলা নিয়ে রেডি হয়ে গেল, বলল," চ' আমিও তোর সাথে যাব।"
নদীকে খুশি করতে পুজো দিল সে, নদী ছেড়ে দিল। বাঘ হালুম করে তেড়ে আসতেই পোঁটলা খুলে তার দিকে ছুঁড়ে দিল রান্না করা মাংস । বাঘ তাই খেয়ে ফুটে গেল। সাপকে দুধকলা দিয়ে আর পাহাড়কে সোনা-রূপো ঘুষ দিয়ে বশ করে ফেলল সে। ভাইয়ের সব অনিষ্ট দূর হয়ে গেল।
উপাচার:-
ধান, দূর্বা, শিশির দিয়ে ঘষা চন্দন, পৈতে ( ব্রাহ্মণ হলে ), পান, সুপারি, নাড়ু, মিষ্টি, পায়েস, জল ও উপহার সামগ্রী
আচার ও অনুষ্ঠান :-
এই দিন বোনেরা উপবাস রেখে ভাইয়ের কপালে বাঁ হাতের অনামিকা আঙ্গুল দিয়ে চন্দন, ঘি, কাজল, মধু , শিশির, গোমূত্র দিয়ে ফোঁটা দিয়ে ভাইয়ের দীর্ঘায়ু কামনা করে থাকে। এই সময় বোনেরা বলেন –
ভ্রাতস্তব ললাটে হি দদামি তিলকং শুভ।
অতঃপরং যমদ্বারে ময়া দত্তং হি কন্টকম্।
“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।”