কৌমুদ্যাং পূজয়েল্লক্ষীমিন্দ্রমৈরাবতস্থিতম্।
সুগন্ধির্নিশি সদ্বেশঃ অক্ষৈর্জাগরণং চরেৎ।।
নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।।" (লিঙ্গ পুরাণ )
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজা প্রদোষের পুজো
'প্রদোষ ব্যাপিনী গ্রাহ্যা তিথির্নক্তব্রতে সদা।
প্রদোষোহ স্তময়াদুর্দ্ধঃ ঘটিকাদ্বয়মিষ্যতে।।'
অর্থাৎ সুর্যাস্ত হবার পরের দুই মুহুর্তকাল বা ১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট, অথবা চার দণ্ড সময়কাল যা ২৪×৪ = ৯৬ মিনিট হলো প্রদোষকাল।
তাহলে সুর্যাস্তের পরে এই ৯৬ মিনিটের মধ্যে যদি পূর্ণিমা থাকে বা প্রবেশ করে বা আংশিকও থাকে তাহলে এই সময়ের মধ্যেই কোজাগরী লক্ষীপুজা করতে হবে।
কে এই লক্ষ্মী ?
পুরাণে আছে দুর্বাসা মুনি দেবরাজ ইন্দ্রকে একটি পারিজাতের মালা উপহার দেন। দেবরাজ অবজ্ঞাভরে সেই মালা নিজের বাহন ঐরাবতের গলায় পরিয়ে দেন। ঐরাবত তো হাতি-ই, আর হাতি তো মালার কদর বোঝে না। ঐরাবত শুঁড় দিয়ে মালা গলা হতে পায়ে ফেলে পদদলিত করে। তখন ঋষি দেবরাজ ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন, - - "ক্ষমতা ও ধনের গর্বে গর্বিত হয়ে আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে।" ঋষিশাপে ইন্দ্রের ইন্দ্রপুরী হলো শ্রীহীন, লক্ষ্মীর আড়াল । লক্ষ্মী প্রবেশ করলেন পাতালে ।সমুদ্র মন্থর সময় পর উত্থিতা হলেন দেবী লক্ষ্মী । তার এক হাতে পদ্ম, আরেক হাতে অমৃতের কলস। তিনি পদ্মাসনা আর বাহন শ্বেত পেঁচা । ইনি বিষ্ণু পত্নী। জ্যোৎস্না প্লাবিত এই পৃথিবীর হেমন্তে আসেন শুধু একটি রাতের অতিথি হয়ে।অপর মতে দেবী ভৃগুর কন্যা, মায়ের নাম খ্যাতি। লক্ষ্মী চঞ্চা, - তবে ক্রোধী নন।
লক্ষ্মী পূজা
গৃহস্থ তার লক্ষ্মীর ঝাঁপি করে লক্ষ্মীর পিঁড়ি পাতেন গৃহেরকোণে - বা কুলুঙ্গিতে। উপাচার তো সামান্যই। প্রতি বৃহস্পতিবারে (লক্ষ্মীবারে ) সামান্য ফুল-বাতাসা আর ধোয়া পিঁড়িতে চাল পিটুলির আলপনা। সেটাই একটু বড় আকারের এই কোজাগরীর রাতে। আগে আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামে দুর্গাপূজা নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাই ছিল বড় উৎসব। এই উৎসবে মহিলারাই প্রধান। তারা আলপনা এঁকে লক্ষ্মীর ঝাঁপি সাজিয়ে বলেন :-‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি।
দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি।
আঁকি মাগো আল্পনা, এই পূজা এই বন্দনা।’
‘আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা।
আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা।’
‘আঁকিলাম আল্পনা, দূরে ফেলি আবর্জনা।
শুভ-শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।’
পূজাপ্রণালী:-
প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উৎস সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম, তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সর্বদা রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে দেবেন। তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন। এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল-নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজাদ্রব্যগুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।
এরপর লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট স্থাপন করবেন। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে নিতে ভুলবেন না। ঘটে একটি আমপল্লব (যাতে বিজোড় সংখ্যায় আমপল্লব থাকে) ও তার উপর একটি কলা বা হরীতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও লক্ষ্মীকে একটি করে মালাও পরাতে পারেন। এবার লক্ষ্মীকে ধ্যান করবেন। লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র হল—
নমঃ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।
মন্ত্রটি পাঠ করতে ভাল। নয়তো লক্ষ্মীর রূপটি চোখ বুজে মনে মনে খানিকক্ষণ চিন্তা করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে আবাহন করবেন। আবাহন মন্ত্রটি হল—
নমঃ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।
সংস্কৃতে মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বাংলায় বলবেন,
এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, যতক্ষণ তোমার পূজা করি, ততক্ষণ তুমি স্থির হয়ে থাকো মা।
তারপর ভাববেন, মা লক্ষ্মী আপনার হৃদয়ে এসে বসে আপনার দেওয়া ফুল-নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। একে বলে মানসপূজা।
এরপর আপনার পূজাদ্রব্যগুলি একে একে লক্ষ্মীকে দেবেন। লক্ষ্মী আপনার গৃহে পূজা নিতে এলেন, তাই প্রথমেই একটুখানি জল ঘটের পাশে লক্ষ্মীপদচিহ্নে দেবেন। এটি মা লক্ষ্মীর পা ধোয়ার জল। এরপর দুর্বা ও একটু আতপ চাল ঘটে দেবেন। এটি হল অর্ঘ্য। এর সঙ্গে একটি ফুলও দিতে পারেন। এরপর লক্ষ্মীকে একটি চন্দনের ফোঁটা দেবেন। লক্ষ্মীর প্রতিমা না থাকলে ফুলে চন্দন মাখিয়ে ঘটে দেবেন। এরপর লক্ষ্মীকে ফুল দেবেন। তারপর প্রথমে ধূপ ও তারপর প্রদীপ দেখাবেন। শেষে নৈবেদ্যগুলি নিবেদন করে দেবেন। তারপর ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন। মন্ত্র—এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।পুষ্পাঞ্জলি এক, তিন বা পাঁচ বার দিতে পারেন। পুষ্পাঞ্জলির পর নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা ঘটে দেবেন। তারপর ইন্দ্র ও কুবেরের নামে দুটি ফুলও ঘটে দেবেন। মা লক্ষ্মীর পেচককেও একটি ফুল দেবেন। আপনি যদি দীক্ষিত হন, তবে এরপর আপনার গুরুমন্ত্র যথাশক্তি জপ করে মা লক্ষ্মীর বাঁ হাতের উদ্দেশ্যে জপসমর্পণ করবেন। শেষে নিম্নোক্ত মন্ত্রে প্রণাম করবেন—
নমঃ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে।।
মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বিনা মন্ত্রেই ভক্তিভরে মা-কে প্রণাম করবেন। এরপর ব্রতকথা পাঠ করবেন বা শুনবেন।
উপসংহার :-
এই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় অনেকে অক্ষক্রীড়া করেন অর্থাৎ এক শ্রেণির লোক এই দিন পাশা খেলার মাধ্যমে টাকা পয়সা বাজি রেখে জুয়া খেলায় মেতে ওঠেন । আবার কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে গাছপালা তছনছ করে । এই সব অর্থহীন কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন । লক্ষ্মীপূজা আমাদের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে কেবল টাকাকড়িই ধন নয়। চরিত্রধন মানুষের মহাধন। যার টাকাকড়ি নেই সে যেমন লক্ষ্মীহীন, যার চরিত্রধন নেই সে তেমনি লক্ষ্মীছাড়া। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা কেন? কেউ কেউ বলেন, লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যারা অপব্যবহার করে, তাদের কপালে লেখা আছে যমের দণ্ড—এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন। তাই কথায় বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। এছাড়া ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা সাধনধনই হোক, সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, তখন পেঁচা জেগে থাকে। পেঁচাই সেই ধনসম্পদ পাহারা দেয়। লক্ষ্মী তাই বাঙালির কাছে সংযম, নিয়মানুবর্তিতা ও জাগরণ তথা উন্নয়নের প্রতীক।