সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা


কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা

                              (আরও পড়ুন- সূচিপত্র *   শ্রী শ্রী লক্ষ্মী দেবীর ব্রতকথা, * অষ্টলক্ষ্মী )                      'কোজাগরী' শব্দটির উৎপত্তি 'কো জাগতী' অর্থাৎ 'কে জেগে আছ? ' কথাটি থেকে। কার্তিক মাসের পূর্ণিমা তিথিতে সারারাত জেগে লক্ষ্মীদেবীর উপাসনা করা হয়। আর তাই এই লক্ষ্মীপূজাকে বলা হয় কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা। যার কিছু নেই সে পাওয়ার আশায় জাগে, আর যার আছে সে না হারানোর আশায় রাত জাগে । আর সারারাত জেগে লক্ষ্মীর আরাধনা করাই এই পুজোর বিশেষ আচার। কথিত আছে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমার দিন দেবী লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা রাত্রে খোঁজ নেন - কে জেগে আছেন ? যে জেগে অক্ষক্রীড়া করে , লক্ষ্মী তাঁকে ধন সম্পদ দান করেন ।
       কৌমুদ্যাং পূজয়েল্লক্ষীমিন্দ্রমৈরাবতস্থিতম্।
        সুগন্ধির্নিশি সদ্বেশঃ অক্ষৈর্জাগরণং চরেৎ।।
        নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ।।" (লিঙ্গ পুরাণ ) 
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজা প্রদোষের পুজো 
'প্রদোষ ব্যাপিনী গ্রাহ্যা তিথির্নক্তব্রতে সদা।
  প্রদোষোহ স্তময়াদুর্দ্ধঃ ঘটিকাদ্বয়মিষ্যতে।।'
অর্থাৎ সুর্যাস্ত হবার পরের দুই মুহুর্তকাল বা ১ ঘন্টা ৩৬ মিনিট, অথবা চার দণ্ড সময়কাল যা ২৪×৪ = ৯৬ মিনিট হলো প্রদোষকাল। 
তাহলে সুর্যাস্তের পরে এই ৯৬ মিনিটের মধ্যে যদি পূর্ণিমা থাকে বা প্রবেশ করে বা আংশিকও থাকে তাহলে এই সময়ের মধ্যেই কোজাগরী লক্ষীপুজা করতে হবে। 
 লক্ষ্মীপুজোয় যে আল্পনা দেওয়া হয়, তাতে মায়ের পায়ের ছাপও আঁকা হয়। বিশ্বাস ওই পথেই মা ঢুকবেন গৃহস্থের ঘরে।
কে এই লক্ষ্মী  ? 
                                                   পুরাণে আছে দুর্বাসা মুনি দেবরাজ ইন্দ্রকে একটি পারিজাতের মালা উপহার দেন। দেবরাজ অবজ্ঞাভরে সেই মালা নিজের বাহন ঐরাবতের গলায় পরিয়ে দেন। ঐরাবত তো হাতি-ই, আর হাতি তো মালার কদর বোঝে না। ঐরাবত শুঁড় দিয়ে মালা গলা হতে পায়ে ফেলে পদদলিত করে। তখন ঋষি দেবরাজ ইন্দ্রকে অভিশাপ দেন, - - "ক্ষমতা ও ধনের গর্বে গর্বিত হয়ে আমার দেওয়া মালা মাটিতে ফেলে দিলে, তাই তোমার ত্রিলোক এখন লক্ষ্মীছাড়া হবে।" ঋষিশাপে ইন্দ্রের ইন্দ্রপুরী হলো শ্রীহীন, লক্ষ্মীর আড়াল । লক্ষ্মী  প্রবেশ করলেন পাতালে ।
                                         সমুদ্র মন্থর সময় পর  উত্থিতা হলেন দেবী লক্ষ্মী । তার এক হাতে পদ্ম, আরেক হাতে অমৃতের কলস।  তিনি পদ্মাসনা আর বাহন শ্বেত পেঁচা । ইনি বিষ্ণু পত্নী। জ্যোৎস্না প্লাবিত এই পৃথিবীর হেমন্তে আসেন শুধু একটি রাতের অতিথি হয়ে।অপর মতে দেবী  ভৃগুর কন্যা, মায়ের নাম খ্যাতি। লক্ষ্মী চঞ্চা, - তবে ক্রোধী  নন।
 লক্ষ্মী পূজা 
                                                               গৃহস্থ তার লক্ষ্মীর ঝাঁপি করে লক্ষ্মীর পিঁড়ি পাতেন গৃহেরকোণে - বা কুলুঙ্গিতে। উপাচার তো সামান্যই। প্রতি বৃহস্পতিবারে (লক্ষ্মীবারে ) সামান্য ফুল-বাতাসা আর ধোয়া পিঁড়িতে চাল পিটুলির আলপনা। সেটাই একটু বড় আকারের এই কোজাগরীর রাতে। আগে আমাদের সমাজে বিশেষ করে গ্রামে দুর্গাপূজা নিয়ে এত মাতামাতি ছিল না। বরং কোজাগরী লক্ষ্মীপূজাই ছিল বড় উৎসব। এই উৎসবে মহিলারাই প্রধান। তারা আলপনা এঁকে লক্ষ্মীর ঝাঁপি সাজিয়ে বলেন :-
  ‘আঁকিলাম পদ দু’টি, তাই মাগো নিই লুটি।
দিবারাত পা দু’টি ধরি, বন্দনা করি।
 আঁকি মাগো আল্পনা, এই পূজা এই বন্দনা।’
 ‘আমি আঁকি পিটুলির গোলা, আমার হোক ধানের গোলা।
  আমি আঁকি পিটুলির বালা, আমার হোক সোনার বালা।’
  ‘আঁকিলাম আল্পনা, দূরে ফেলি আবর্জনা।
শুভ-শুদ্ধ মন নিয়ে, করি তব আরাধনা।’
পূজাপ্রণালী:-

প্রথমে মাথায় একটু গঙ্গাজল নিয়ে নারায়ণকে স্মরণ করে নিন। পূজার আগে মাথায় জল নিয়ে দেহ ও নারায়ণকে স্মরণ করে মন শুদ্ধ করে নেবেন। তারপর সূর্যের উদ্দেশ্যে একটু জল দিন। যে কোনো পূজার আগে আমাদের প্রাণশক্তির উৎস সূর্যকে জল দেওয়ার নিয়ম, তাই জল দেওয়ার জন্য ঠাকুরের সিংহাসনে একটি ছোটো তামার পাত্র সর্বদা রাখবেন। সূর্যের নাম করে সেই কুশীতে জল নিয়ে সেই তামার পাত্রে দেবেন। তারপর সংসারের সকলের মঙ্গলকামনা করবেন। এরপর একটু গঙ্গাজল আপনার পূজার আসন, পূজার ফুল-নৈবেদ্য ইত্যাদি উপকরণের উপর ছিটিয়ে দেবেন। এইভাবে পূজাদ্রব্যগুলিকে শুদ্ধ করে নিতে হয়।

এরপর লক্ষ্মীর সামনে সামান্য ধান ও এক চিমটি মাটি ছড়িয়ে দিয়ে তার উপর জলভরা ঘট স্থাপন করবেন। ঘটের গায়ে সিঁদুর দিয়ে মঙ্গলচিহ্ন এঁকে নিতে ভুলবেন না। ঘটে একটি আমপল্লব (যাতে বিজোড় সংখ্যায় আমপল্লব থাকে) ও তার উপর একটি কলা বা হরীতকী দিয়ে উপরে একটি ফুল দেবেন। ইচ্ছা করলে ঘটে ও লক্ষ্মীকে একটি করে মালাও পরাতে পারেন। এবার লক্ষ্মীকে ধ্যান করবেন। লক্ষ্মীর ধ্যানমন্ত্র হল—

নমঃ   পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।

পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।

গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।

রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।।

মন্ত্রটি পাঠ করতে ভাল। নয়তো লক্ষ্মীর রূপটি চোখ বুজে মনে মনে খানিকক্ষণ চিন্তা করবেন। এরপর মা লক্ষ্মীকে আপনার ঘরে আবাহন করবেন। আবাহন মন্ত্রটি হল—

নমঃ লক্ষ্মীদেবী ইহাগচ্ছ ইহাগচ্ছ ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ ইহ সন্নিধেহি ইহ সন্নিরুদ্ধস্য অত্রাধিষ্ঠান কুরু মম পূজান গৃহাণ।

সংস্কৃতে মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বাংলায় বলবেন,
এসো মা লক্ষ্মী, বসো মা লক্ষ্মী, যতক্ষণ তোমার পূজা করি, ততক্ষণ তুমি স্থির হয়ে থাকো মা।

তারপর ভাববেন, মা লক্ষ্মী আপনার হৃদয়ে এসে বসে আপনার দেওয়া ফুল-নৈবেদ্য গ্রহণ করছেন। একে বলে মানসপূজা।

এরপর আপনার পূজাদ্রব্যগুলি একে একে লক্ষ্মীকে দেবেন। লক্ষ্মী আপনার গৃহে পূজা নিতে এলেন, তাই প্রথমেই একটুখানি জল ঘটের পাশে লক্ষ্মীপদচিহ্নে দেবেন। এটি মা লক্ষ্মীর পা ধোয়ার জল। এরপর দুর্বা ও একটু আতপ চাল ঘটে দেবেন। এটি হল অর্ঘ্য। এর সঙ্গে একটি ফুলও দিতে পারেন। এরপর লক্ষ্মীকে একটি চন্দনের ফোঁটা দেবেন। লক্ষ্মীর প্রতিমা না থাকলে ফুলে চন্দন মাখিয়ে ঘটে দেবেন। এরপর লক্ষ্মীকে ফুল দেবেন। তারপর প্রথমে ধূপ ও তারপর প্রদীপ দেখাবেন। শেষে নৈবেদ্যগুলি নিবেদন করে দেবেন। তারপর ফুল দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি দেবেন। মন্ত্র—এষ সচন্দনপুষ্পাঞ্জলি নমঃ শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ।পুষ্পাঞ্জলি এক, তিন বা পাঁচ বার দিতে পারেন। পুষ্পাঞ্জলির পর নারায়ণের উদ্দেশ্যে একটি ফুল ও দুটি তুলসীপাতা ঘটে দেবেন। তারপর ইন্দ্র ও কুবেরের নামে দুটি ফুলও ঘটে দেবেন। মা লক্ষ্মীর পেচককেও একটি ফুল দেবেন। আপনি যদি দীক্ষিত হন, তবে এরপর আপনার গুরুমন্ত্র যথাশক্তি জপ করে মা লক্ষ্মীর বাঁ হাতের উদ্দেশ্যে জপসমর্পণ করবেন। শেষে নিম্নোক্ত মন্ত্রে প্রণাম করবেন—

নমঃ   বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।

সর্বতঃ পাহি মাং দেবি মহালক্ষ্মী নমঽস্তু তে।।

মন্ত্র পড়তে অক্ষম হলে বিনা মন্ত্রেই ভক্তিভরে মা-কে প্রণাম করবেন। এরপর ব্রতকথা  পাঠ করবেন বা শুনবেন।
উপসংহার :-
                                             এই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় অনেকে অক্ষক্রীড়া করেন  অর্থাৎ  এক শ্রেণির লোক এই দিন পাশা খেলার মাধ্যমে টাকা পয়সা বাজি রেখে জুয়া খেলায় মেতে ওঠেন । আবার কেউ কেউ এই দিন পরের বাগানের ফলমূল চুরি করে গাছপালা তছনছ করে । এই সব অর্থহীন কাজের মাধ্যমে তারা ভাবে যে লক্ষ্মী দেবী তাদের কৃপা করবেন । লক্ষ্মীপূজা আমাদের জীবনে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। আসলে কেবল টাকাকড়িই ধন নয়। চরিত্রধন মানুষের মহাধন। যার টাকাকড়ি নেই সে যেমন লক্ষ্মীহীন, যার চরিত্রধন নেই সে তেমনি লক্ষ্মীছাড়া।  লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা কেন? কেউ কেউ বলেন, লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যারা অপব্যবহার করে, তাদের কপালে লেখা আছে যমের দণ্ড—এই কথা ঘোষণা করে লক্ষ্মীর বাহন। তাই কথায় বলে, ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’। এছাড়া ধনসম্পত্তি, সে টাকাকড়ি হোক বা সাধনধনই হোক, সদাজাগ্রত অবস্থায় রক্ষা করতে হয়। রাতে সবাই যখন ঘুমায়, তখন পেঁচা জেগে থাকে। পেঁচাই সেই ধনসম্পদ পাহারা দেয়। লক্ষ্মী তাই বাঙালির কাছে সংযম, নিয়মানুবর্তিতা ও জাগরণ তথা উন্নয়নের প্রতীক।




শুক্রবার, ১৯ অক্টোবর, ২০১৮

বিজয়া


শুভ বিজয়া 

যাসনে মা উমা যাসনে মা, উমা দন্ডদুয়েক থাক মা ঘরে,
তুই গেলে গো মা হরমনোরমা মন যে গো মা কেমন করে।
বছরের পর এলি উমা ঘর সঙ্গেতে শঙ্কর আনিলি ক্যানে !
সে পাগল ভোলা লয়ে ভূতচেলা ঘুরুক এবেলা শ্মশানে শ্মশানে।
কে বলে পার্বতী তোর পিতা মূঢ়মতি, - সে কি জানে কত হৃদয় বিদারে?
হইয়ে পাষান বিদরে পরাণ সঁপেছি পরাণ পাগলের করে;-
যদি যাস উমা পরাণপ্রতীমা কি পরাণ লয়ে থাকিব ঘরে?
নয়নের জলে পাষান বিগলে তবু কি গো টলে পাগলের হিয়া
সুব্রত বলে দেখ দ্বার খুলে সে পাগল ভোলা দুয়ারে বসিয়া।
আমার লেখা বিজয়ার গান। প্রথা ভেঙে এই গানে পিতৃহৃদয়ের যে ব্যাথা তা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে মেনকা নন পাষান গিরিই উমার বিচ্ছেদ ভাবনায় কাতর। ) 

মঙ্গলবার, ১৬ অক্টোবর, ২০১৮

Durga dhyaan - দুর্গাধ্যান

শ্রী শ্রী দুর্গা ধ্যান 

জটাজুট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।
লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্।।২।।
অতসীপুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।
নবযৌবন সম্পন্নাং সর্ব্বাভরণ ভূষিতাম্।।৪।।

সূচারু দশনাং তদ্বৎ পীনোন্নত পয়োধরাম্।
ত্রিভঙ্গস্থান সংস্থানাং মহিসাসুরমর্দীনিম্।।৬।।
মৃণালায়াত সংস্পর্শ দশবাহু সমন্বিতাম্।
ত্রিশুলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খর্গং-চক্রং ক্রমাদধঃ।।৮।।

তীক্ষ্ণবাণং তথা শক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ।
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ।।১০।।
ঘণ্টাং বা পরশুং বাপি বামতঃ সন্নিবেশয়েৎ।
অধস্থান মহিষং তদ্বৎবিশিরক্ষং প্রদর্শয়েৎ।।১২।।

শিরোচ্ছেদোদ্ভবং তদ্বৎ দানবং খর্গপাণিনম্।
হৃদি শুলেন নির্ভিন্নং নির্যদন্ত্র বিভূষিতম্।।১৪।।
রক্তারক্তী কৃতাঙ্গঞ্চ রক্তবিস্ফুরিতেক্ষণম্।
বেষ্টিতং নাগপাশেন ভ্রূকুটি ভীষণাননাম্।।১৬।।

সপাশ বামহস্তেন ধৃতকেশঞ্চ দুর্গয়া।
বমদ্রুধির বক্ত্রঞ্চ দেব্যা সিংহং প্রদর্শয়েৎ।।১৮।।
দেব্যাস্তু দক্ষিণাং পাদং সমং সিংহোপরিস্থিতম্।
কিঞ্চিৎ ঊর্ধ্বং তথা বামঅঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি।।২০।।
স্তুয়মানঞ্চ তদ্রূপ মমরৈঃ সন্নিবেশয়েৎ।
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকাম ফলপ্রদাং।।২২।।

উগ্রচন্ডা প্রচন্ডা চ চন্ডোগ্রা চন্ডনায়িকা।
চন্ডা চন্ডবতী চৈব চন্ডরূপাতিচন্ডিকা।।২৪।।
অষ্টাভি শক্তিভিরষ্টাভিঃ সততং পরিবেষ্টিতাম্।
চিন্তয়েৎ জগতাং ধাত্রিং ধর্মকামার্থ মোক্ষদাম্।।২৬।।

ব্যাখ্যা

দেবীর মাথায় জটা, সাথে অর্ধচন্দ্রের মত কপাল। পূর্ণিমার চাঁদের মত মুখ তাঁর ও গায়ের রঙ অতসীফুলের মতো। তিনি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত এবং তাঁর সর্বাঙ্গ বিভিন্ন অলঙ্কার দ্বারা ভূষিত। ।২-৪।

তাঁর দাঁত সুন্দর এবং ধারালো, স্তন সম্পূর্ণ। তিন ভাঁজে দাঁড়িয়ে তিনি দৈত্যনিধন করছেন। দশহাতভর্তি অস্ত্র তাঁর যা দেখতে শাখা-প্রশাখা সমন্বিত পদ্ম গাছের মতো। ডানদিকের উপরের হাতে অবস্থান করে ত্রিশুল, তারপর ক্রমান্বয়েখর্গ এবং চক্র। ।৬-৮।

দেবীর দক্ষিণের সর্বনিম্ন দুই হাতের অস্ত্র ধারালো তীর এবং বর্শা। দেবীর ধ্যানে বর্ণিত হয় তাঁর বাঁ হস্ত। সেদিকে সবচেয়ে নিচের হাতে থাকে চামড়ার ঢাল ও তার উপরের হাতে ধনুক। সেগুলির উপরের হাতে থাকে সর্প, অঙ্কুশ এবং কুঠার (ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে)। দেবীর পায়ের কাছে দৈত্যরাজের মাথার স্থান। ।১০-১২।

মহিষের কাটা মাথা থেকে মহিসাসুরের দেহ অর্ধেক উত্থাপিত, হাতে তাঁর খর্গ এবং হৃদয়ে দেবীর ত্রিশূল দ্বারা বিদ্ধ। তাঁর পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি নির্গত হয়েছে। শরীর রক্তলিপ্ত। দেবীর হাতে ধরা সাপ দ্বারা অসুরের দেহ বেষ্টিত। তবে উত্থিত ভ্রূ তে দৈত্যের রূপও ভয়ঙ্কর। ।১৪-১৬।

দেবী তাঁর বাম হাত দিয়ে দৈত্যরাজের চুল টেনে রেখেছেন। দেবীর ডান পা বাহন সিংহের উপরে এবং বাঁ পা কিঞ্চিৎ উর্ধে মহিষের উপরে অবস্থান করে। প্রবল যুদ্ধরত অবস্থাতেও দেবী তাঁর শান্তিপূর্ণ মুখাবয়ব ও আশীর্বাদী রূপ বজায় রেখেছেন এবং সমস্ত দেবতা দেবীর এই রূপের স্তুতি করেন। ।১৮-২২।
                             
দেবীর উপরোক্ত রূপ দেবতাদের আট শক্তি উগ্রচন্ডা, প্রচন্ডা, চন্ডোগ্রা, চন্ডনায়িকা, চন্ডা, চন্ডবতী, চন্ডরূপ ও অতিচন্ডিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। গৃহকর্তার মানব জীবনের সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ করেন এই দেবী। তাই ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ লাভের জন্য জগন্মাতৃকা দেবী দুর্গার ধ্যানই মানবজাতির হওয়া উচিত। ।২৪-২৬।
নবদুর্গা 
ওঁ প্রথমং শৈলপুত্রী দ্বিতীয়ম ব্রহ্মচারিনী , তৃতীয় চন্দ্রঘনটে , কুস্মানডেতি চতুরথাকম , পঞ্চমম স্কন্দমাতেতি ,ষষ্ঠম কাত্যায়নী তথা , সপ্তমম কালরাত্রিতি মহাগৌরী , তিচাস্তমাম , নবমাম সিদ্ধিদ্ধাত্রিতি নবদুর্গা প্রকীতিতা ।


বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮

গান্ধারীর শতপুত্রের নাম

সূচিপত্র
                    একনজরে দেখে নেওয়া যাক গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের ১০০ পুত্রের নাম:
১. দুর্যোধন, ২. যুযুত্‍সু, ৩. দুঃশাসন, ৪. দুঃসহ, ৫. দুঃশল, ৬. দুর্মুখ, ৭. বিবিংশতি, ৮. বিকর্ণ, ৯. জলসন্ধ, ১০.সুলোচন, ১১. বিন্দ, ১২. অনুবিদ, ১৩. দুর্ধর্ষ, ১৪. সুবাহু, ১৫. দুষ্প্রধর্ষণ, ১৬. দুমর্শণ, ১৭. দুর্মুখ ১৮. দুস্কর্ণ, ১৯. কর্ণ, ২০. চিত্র, ২১. উপচিত্র, ২২. চিত্রাক্ষ, ২৩. চারুচিত্র, ২৪. অঙ্গদ, ২৫. দুর্মদ, ২৬. দুস্পহরশ, ২৭. বিবিত্‍সু, ২৮. বিকট ২৯. মম, ৩০. ঊর্ণনাভ, ৩১. পদ্মনাভ, ৩২. নন্দ, ৩৩. উপনন্দ, ৩৪. সেনাপতি, ৩৫. সুষেণ, ৩৬. কুন্দদর, ৩৭. মহোদর, ৩৮. চিত্রবাহু, ৩৯. চিত্রবর্মা, ৪০. সুবর্মা, ৪১. দুরোবিরোচন, ৪২. অয়োবাহু, ৪৩. মহাবাহু, ৪৪. চিত্রচাপ, ৪৫. সুকুন্ডল, ৪৬. ভীমবেগ, ৪৭. ভীমবল, ৪৮. বলাকা, ৪৯. ভাবাবক্রম, ৫০. উগায়ুধ ৫১. ভীমশ্বর, ৫২. কনকায়ু, ৫৩. দৃরায়ুধ, ৫৪. দৃঢ়বর্মা, ৫৫. দৃঢ়ক্ষেত্র, ৫৬. সোমকীর্তি, ৫৭. অনুদর, ৫৮. জরাসন্ধ, ৫৯. ধৃঢ়সন্ধ, ৬০. সত্যসন্ধ, ৬১. সহস্রবাক, ৬২. উগ্রসবা, ৬৩. উগ্রসেন, ৬৪. ক্ষেমমূর্তি, ৬৫. অপরাজিত, ৬৬. পন্ডিততস্ক, ৬৭. বিশাললক্ষ, ৬৮. দুরাধন, ৬৯. দৃঢ়হস্ত, ৭০. সুহস্ত, ৭১. বাতবেগ, ৭২. সুবরচা, ৭৩. আদিত্যকেতু, ৭৪. বহবাশী, ৭৫. নাগদত্ত, ৭৬. অনুযায়ী, ৭৭. নিসঙ্গী, ৭৮. কবচী, ৭৯. দণ্ডি, ৮০. দণ্ডধার ৮১. ধনুরগ্রহ, ৮২. উগ্র, ৮৩.ভীমরথ, ৮৪. বীর, ৮৫. বীরবাহু, ৮৬. অলুলোপ, ৮৭. অভয়, ৮৮. রৌদ্রকর্মা, ৮৯. দৃঢ়রথ, ৯০. চয়, ৯১. অনাধৃশ্য, ৯২. কুন্দভেদী, ৯৩. বিবারী, ৯৪. দীর্ঘলোচন, ৯৫. দীর্ঘবাহু, ৯৬. মহাবাহু, ৯৭. বুঢরু, ৯৮. কনকাঙ্গদ, ৯৯. কুন্ডজ, ১০০. চিত্রক।

মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৮

অকাল বোধন

অকাল বোধন


“মৃগকর্কটসংক্রান্তিঃ দ্বে তূদগ্দক্ষিণায়নে।
বিষুবতী তুলামেষে গোলমধ্যে তথাপরাঃ ॥”

অর্থাৎ সুর্য ধনুরাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে সঞ্চার হওয়াকে উত্তরায়ণসংক্রান্তি, মিথুনরাশি হতে কর্কটরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, কন্যারাশি হতে তুলারাশিতে সঞ্চার হওয়াকে জলবিষুবসংক্রান্তি আর মীনরাশি হতে মেষরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে।  
                                                               উত্তরায়ণে দেবতারা জেগে থাকেন, - তখন তাদের দিন। দক্ষিণায়ণে রাত্রিকাল। শরৎ কালে দক্ষিণায়ণ, এসময় তাই দেবপুজায় দেবতাদের জাগাতে হয়। এই জাগানোই হল বোধন।  এজন্য বাসন্তী পূজায় বোধন করতে হয় না। মাঘ থেকে আষাঢ় ছ’মাস উত্তরায়ণ; এ সময় দেবতারা জাগ্রত। শরৎ ঋতু দক্ষিণায়নে পড়ে, তখন দেবী নিদ্রিতা, এজন্য শারদীয়া দুর্গাপূজায় দেবীর জাগরণের জন্য বোধন করতে হয়। অকাল বোধন মানে অকালে জাগরণ।হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু দেবী দুর্গার পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
                    ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
              অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
                  অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
অর্থাৎ, রাবণকে নাশ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য অকালে দেবীকে জাগরিত করা হয়েছিল।  কালিকা পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মরাত্রিতে দেবীর বোধন করেছিলেন শ্রীরামচন্দ ।
                  চণ্ডীপাঠ করি রাম করিল উৎসব।
                   গীত নাট করে জয় দেয় কপি সব।।
                    সায়াহ্নকালেতে রাম করিল বোধন।
                     আমন্ত্রণ অভয়ার বিল্বাধিবাসন।। …
                    আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
                    বান্ধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।

ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ১০৮ পদ্ম দ্বারা দেবীপূজার সঙ্কল্প করেন। হনুমান পদ্মগুলি সংগ্রহ করে আনেন । দেবী ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করার জন্য ছলনা করলেন। তিনি একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার সময় একটি পদ্মের অভাব হওয়ায় শ্রীরামচন্দ্র বিপদে পড়লেন। পূজা পূর্ণাঙ্গ না হলে দেবী অসন্তুষ্ট হবেন, সঙ্কল্পও সিদ্ধ হবে না। শ্রীরামচন্দ্র পদ্মলোচন নামে অভিহিত। সেজন্য তিনি নিজের একটি চক্ষুু উৎপাটিত করে তা মায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দেবেন- এরূপ সঙ্কল্প করলেন। তিনি ধনুর্বাণ হস্তে চক্ষু উৎপাটন করবার উপক্রম করতেই দেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে অভীষ্ট বর প্রদান করলেন।

আদ্যাশক্তি যদিও স্বরূপত : নামরূপাতীতা, তথাপি তিনিই মায়ারূপ মহিমাদ্বারা সমস্ত বস্তুরূপে সম্ভূতা হন। শাস্ত্রে রয়েছে- ত্বমেব সূক্ষ্মা স্থূলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী। নিরাকারাপি সাকারা কস্ত¡াং বেদিতুমর্হতি ॥ অর্থাৎ, তুমিই আদ্যাশক্তি ভগবতী সূক্ষ্মা ও স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত স্বরূপিণী, নিরাকারা হয়েও সাকারা, তোমাকে কে জানতে পারে? কল্পনাময়ীর সঙ্কল্পশক্তি অমোঘ। কেননা কল্পনাময়ী চিন্ময়ী। সঙ্কল্প মাত্রই ইনি অনন্তকোটি বিশ্ব প্রসব করে থাকেন। অবাধ সৃষ্টি করাই তাঁর স্বভাব। সর্বজীবের জননী তিনি।

শ্রী শ্রী চন্ডী অনুসারে , দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা নামে খ্যাত হন । দুর্গমাসুর  জীবকে দুর্গতি প্রদান করত । সংসার পথে এ অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা। আধ্যাত্মিক পথে এ অসুরের নাম অবিদ্যা। দুর্গম স্বার্থান্ধতায় পতিত হয়ে জীব অশেষ দুর্গতি ভোগ করে। লোককল্যাণ বুদ্ধি জাগ্রত করে মা দুর্গা রক্ষা করেন।আবার সনাতন ধর্মশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। দুর্গা শব্দের অপরার্থ  দুর্জ্ঞেয়া। মায়ের তত্ত্ব দুরধিগম্য;--  আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির সামর্থ্য নেই তাঁকে জানা। তিনি কৃপা করে জানালে তবে জানতে পারি। সকল বস্তুতে যিনি মাতৃরূপে বিরাজিতা তিনিই বিশ্বজননী মা দুর্গা। 
আবার এই অকাল বোধনের সাথে জড়িত শরৎবিষুব। বৈদিক যুগে এক সময় শরৎকালে বছর শুরু হতো।আর নতুন বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতো রুদ্রযজ্ঞ  । তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে শরৎকেই অম্বিকা বলা হয়েছে। রুদ্রের বোন অম্বিকা। অম্বিকার সাহায্যে রুদ্র ধ্বংস করেন। তার সাহায্যে যাকে ধ্বংস করেন, তুষ্ট হয়ে তিনিই তাকে শান্ত করেন।তাই আচার্য মহীধর লিখেছেন, যিনি রুদ্র নামক নিষ্ঠুর দেবতা, তার বিরোধীকে হত্যা করতে ইচ্ছে করেন এবং অম্বিকার সাহায্যে সে ইচ্ছা পূরণ করেন।
শরৎকালে নানা রোগে দেশে মড়ক দেখা দিত। নতুন বছরের শুরুতে সবাই রুদ্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন সব জীবের শান্তি কামনায়। তারা বিশ্বাস করতেন, অম্বিকাই শরৎরূপ ধারণ করে রুদ্রের ধ্বংস কাজে রোগ সৃষ্টির দ্বারা সাহায্য করে থাকেন। তাই রুদ্রযজ্ঞে রুদ্রের সঙ্গে অম্বিকাকেও খুশি করার আয়োজন করা হতো। এই অনুষ্ঠানই পরবর্তীতে দুর্গাপূজার রূপ নেয়। সংক্ষেপে দুর্গাপুজো সম্পর্কে বলা হয় - 

বোধয়েদ্বিল্বশাখায়াং ষষ্ঠ্যাং দেবীং ফলেষু চ।
সপ্তম্যাং বিল্বশাখাং তামাহৃত্য প্রতিপূজয়েৎ ॥
পুনঃ পূজাং তথাষ্ঠম্যাং বিশেষেণ সমাচরেৎ।
জাগরঞ্চ স্বয়ং কুর্য্যাদ্বলিদানং তথা নিশি ৷।
প্রভূতবলিদানন্ত নবম্যাং বিধিবচ্চরেৎ
ধ্যায়েদ্দশভুজাং দেবীং দুর্গা মন্ত্রেণ পূজয়েৎ।
বিসর্জ্জনং দশম্যান্ত কুর্য্যাদ্বৈ শারদোৎসবৈঃ ॥
                                 - কালিকা পুরাণম
অর্থাৎ  শারদ আশ্বিন মাসের মুখ্যচান্দ্র ষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে ফলযুক্ত বিল্বশাখায় বোধন করতে হবে। সপ্তমী তিথিতে সেই বিল্বশাখা আহরন পুর্বক তাতে দেবীর পুজা করতে হবে। অষ্টমী তিথিতে বিশেষভাবে দেবীর পুজা করে ও রাত্রি জাগরণ পুর্বক বলিদান সহকারে দেবীর পুজা করতে হবে। নবমী তিথিতে দশভুজা দুর্গার ধ্যান সহকারে, বিবিধ উপচারে পুজা, বলিদান পুর্বক দেবীর নবমী পুজা বিহিত হোম সম্পন্ন করতে হবে।  দশমী তিথিতে শারদোৎসব বিহিত দেবীর বিসর্জ্জন করতে হবে।