মঙ্গলবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৮

অকাল বোধন

অকাল বোধন


“মৃগকর্কটসংক্রান্তিঃ দ্বে তূদগ্দক্ষিণায়নে।
বিষুবতী তুলামেষে গোলমধ্যে তথাপরাঃ ॥”

অর্থাৎ সুর্য ধনুরাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে সঞ্চার হওয়াকে উত্তরায়ণসংক্রান্তি, মিথুনরাশি হতে কর্কটরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, কন্যারাশি হতে তুলারাশিতে সঞ্চার হওয়াকে জলবিষুবসংক্রান্তি আর মীনরাশি হতে মেষরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে।  
                                                               উত্তরায়ণে দেবতারা জেগে থাকেন, - তখন তাদের দিন। দক্ষিণায়ণে রাত্রিকাল। শরৎ কালে দক্ষিণায়ণ, এসময় তাই দেবপুজায় দেবতাদের জাগাতে হয়। এই জাগানোই হল বোধন।  এজন্য বাসন্তী পূজায় বোধন করতে হয় না। মাঘ থেকে আষাঢ় ছ’মাস উত্তরায়ণ; এ সময় দেবতারা জাগ্রত। শরৎ ঋতু দক্ষিণায়নে পড়ে, তখন দেবী নিদ্রিতা, এজন্য শারদীয়া দুর্গাপূজায় দেবীর জাগরণের জন্য বোধন করতে হয়। অকাল বোধন মানে অকালে জাগরণ।হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি অথবা শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু দেবী দুর্গার পূজারম্ভের প্রাক্কালে এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়।
                    ওঁ ঐং রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানুগ্রহায় চ।
              অকালে ব্রহ্মণা বোধো দেব্যস্তয়ি কৃতঃ পুরা।।
                  অহমপাশ্বিনে ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়মি বৈ।
অর্থাৎ, রাবণকে নাশ করার জন্য শ্রীরামচন্দ্রকে অনুগ্রহ করার জন্য অকালে দেবীকে জাগরিত করা হয়েছিল।  কালিকা পুরাণ অনুসারে ব্রহ্মরাত্রিতে দেবীর বোধন করেছিলেন শ্রীরামচন্দ ।
                  চণ্ডীপাঠ করি রাম করিল উৎসব।
                   গীত নাট করে জয় দেয় কপি সব।।
                    সায়াহ্নকালেতে রাম করিল বোধন।
                     আমন্ত্রণ অভয়ার বিল্বাধিবাসন।। …
                    আচারেতে আরতি করিলা অধিবাস।
                    বান্ধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।।

ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ১০৮ পদ্ম দ্বারা দেবীপূজার সঙ্কল্প করেন। হনুমান পদ্মগুলি সংগ্রহ করে আনেন । দেবী ভক্তের ভক্তি পরীক্ষা করার জন্য ছলনা করলেন। তিনি একটি পদ্ম লুকিয়ে রাখলেন। পূজার সময় একটি পদ্মের অভাব হওয়ায় শ্রীরামচন্দ্র বিপদে পড়লেন। পূজা পূর্ণাঙ্গ না হলে দেবী অসন্তুষ্ট হবেন, সঙ্কল্পও সিদ্ধ হবে না। শ্রীরামচন্দ্র পদ্মলোচন নামে অভিহিত। সেজন্য তিনি নিজের একটি চক্ষুু উৎপাটিত করে তা মায়ের শ্রীচরণে অঞ্জলি দেবেন- এরূপ সঙ্কল্প করলেন। তিনি ধনুর্বাণ হস্তে চক্ষু উৎপাটন করবার উপক্রম করতেই দেবী আবির্ভূত হয়ে তাঁকে অভীষ্ট বর প্রদান করলেন।

আদ্যাশক্তি যদিও স্বরূপত : নামরূপাতীতা, তথাপি তিনিই মায়ারূপ মহিমাদ্বারা সমস্ত বস্তুরূপে সম্ভূতা হন। শাস্ত্রে রয়েছে- ত্বমেব সূক্ষ্মা স্থূলা ত্বং ব্যক্তাব্যক্তস্বরূপিণী। নিরাকারাপি সাকারা কস্ত¡াং বেদিতুমর্হতি ॥ অর্থাৎ, তুমিই আদ্যাশক্তি ভগবতী সূক্ষ্মা ও স্থূলা, ব্যক্ত ও অব্যক্ত স্বরূপিণী, নিরাকারা হয়েও সাকারা, তোমাকে কে জানতে পারে? কল্পনাময়ীর সঙ্কল্পশক্তি অমোঘ। কেননা কল্পনাময়ী চিন্ময়ী। সঙ্কল্প মাত্রই ইনি অনন্তকোটি বিশ্ব প্রসব করে থাকেন। অবাধ সৃষ্টি করাই তাঁর স্বভাব। সর্বজীবের জননী তিনি।

শ্রী শ্রী চন্ডী অনুসারে , দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা নামে খ্যাত হন । দুর্গমাসুর  জীবকে দুর্গতি প্রদান করত । সংসার পথে এ অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা। আধ্যাত্মিক পথে এ অসুরের নাম অবিদ্যা। দুর্গম স্বার্থান্ধতায় পতিত হয়ে জীব অশেষ দুর্গতি ভোগ করে। লোককল্যাণ বুদ্ধি জাগ্রত করে মা দুর্গা রক্ষা করেন।আবার সনাতন ধর্মশাস্ত্রে ‘দুর্গা’ নামটির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ‘উ-কার’ বিঘ্ননাশক, ‘রেফ’ রোগনাশক, ‘গ’ অক্ষর পাপনাশক ও অ-কার ভয়-শত্রুনাশক। অর্থাৎ দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। বিপদনাশিনী দেবীমাতা দুর্গা। দুর্গা শব্দের অপরার্থ  দুর্জ্ঞেয়া। মায়ের তত্ত্ব দুরধিগম্য;--  আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির সামর্থ্য নেই তাঁকে জানা। তিনি কৃপা করে জানালে তবে জানতে পারি। সকল বস্তুতে যিনি মাতৃরূপে বিরাজিতা তিনিই বিশ্বজননী মা দুর্গা। 
আবার এই অকাল বোধনের সাথে জড়িত শরৎবিষুব। বৈদিক যুগে এক সময় শরৎকালে বছর শুরু হতো।আর নতুন বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হতো রুদ্রযজ্ঞ  । তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে শরৎকেই অম্বিকা বলা হয়েছে। রুদ্রের বোন অম্বিকা। অম্বিকার সাহায্যে রুদ্র ধ্বংস করেন। তার সাহায্যে যাকে ধ্বংস করেন, তুষ্ট হয়ে তিনিই তাকে শান্ত করেন।তাই আচার্য মহীধর লিখেছেন, যিনি রুদ্র নামক নিষ্ঠুর দেবতা, তার বিরোধীকে হত্যা করতে ইচ্ছে করেন এবং অম্বিকার সাহায্যে সে ইচ্ছা পূরণ করেন।
শরৎকালে নানা রোগে দেশে মড়ক দেখা দিত। নতুন বছরের শুরুতে সবাই রুদ্রযজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন সব জীবের শান্তি কামনায়। তারা বিশ্বাস করতেন, অম্বিকাই শরৎরূপ ধারণ করে রুদ্রের ধ্বংস কাজে রোগ সৃষ্টির দ্বারা সাহায্য করে থাকেন। তাই রুদ্রযজ্ঞে রুদ্রের সঙ্গে অম্বিকাকেও খুশি করার আয়োজন করা হতো। এই অনুষ্ঠানই পরবর্তীতে দুর্গাপূজার রূপ নেয়। সংক্ষেপে দুর্গাপুজো সম্পর্কে বলা হয় - 

বোধয়েদ্বিল্বশাখায়াং ষষ্ঠ্যাং দেবীং ফলেষু চ।
সপ্তম্যাং বিল্বশাখাং তামাহৃত্য প্রতিপূজয়েৎ ॥
পুনঃ পূজাং তথাষ্ঠম্যাং বিশেষেণ সমাচরেৎ।
জাগরঞ্চ স্বয়ং কুর্য্যাদ্বলিদানং তথা নিশি ৷।
প্রভূতবলিদানন্ত নবম্যাং বিধিবচ্চরেৎ
ধ্যায়েদ্দশভুজাং দেবীং দুর্গা মন্ত্রেণ পূজয়েৎ।
বিসর্জ্জনং দশম্যান্ত কুর্য্যাদ্বৈ শারদোৎসবৈঃ ॥
                                 - কালিকা পুরাণম
অর্থাৎ  শারদ আশ্বিন মাসের মুখ্যচান্দ্র ষষ্ঠী তিথিতে দেবীকে ফলযুক্ত বিল্বশাখায় বোধন করতে হবে। সপ্তমী তিথিতে সেই বিল্বশাখা আহরন পুর্বক তাতে দেবীর পুজা করতে হবে। অষ্টমী তিথিতে বিশেষভাবে দেবীর পুজা করে ও রাত্রি জাগরণ পুর্বক বলিদান সহকারে দেবীর পুজা করতে হবে। নবমী তিথিতে দশভুজা দুর্গার ধ্যান সহকারে, বিবিধ উপচারে পুজা, বলিদান পুর্বক দেবীর নবমী পুজা বিহিত হোম সম্পন্ন করতে হবে।  দশমী তিথিতে শারদোৎসব বিহিত দেবীর বিসর্জ্জন করতে হবে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন