শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১

জীতাষ্টমী

 জিতাষ্টমী ব্রত

 দুর্গা মহাষ্টমীর আগের অষ্টমী তিথি হল জিতাষ্টমী। জিতাষ্টমীর পরপরই দুর্গাপুজো হয় বলে বলা হয় -'জিতার ডালায় বোধন আসে' । '
'জীতা' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত 'জীবিত' শব্দ হতে। মায়েরা তাদের পুত্রকন্যার দীর্ঘায়ু কামনা করে এই ব্রত করেন। ওড়িশাতে আবার এই জিতাষ্টমী দুরকম- পুয়া জিউন্তিয়া বা পুত্র জীবক এবং ভাই জিউন্তিয়া বা ভাই জীবক। একে আবার বড়ষষ্ঠীও বলে। 
এই ব্রত মূলত জীমূতবাহনকে উপলক্ষ্য করে। এই আক্ষরিক অর্থে জীমূতবাহন হলেন মেঘের দেবতা ইন্দ্র ।
অনেকে জীমূতবাহন বলতে ইন্দ্রের কথা মনে করতেই পারেন। কিন্তু এই দেবতা ইন্দ্র নন। ইনি সূর্যপুত্র। ঘোড়ার উপর বসে এক হাতে তার লাগাম টেনে ধরেন আর আরেক হাতে থাকে ঘোড়াকে শাসন করার চাবুক। উজ্জ্বল গৌর বর্ণের এই দেবতা তার ব্রত যারা করেন সেই সমস্ত নিঃসন্তান মানুষদের সন্তান লাভের বর দেন। 
ব্রতের নিয়ম :-
ব্রতের আগেরদিন 'আঁকুরি পাতা' হয়। একটা পাত্রে ছোলা ভিজাতে দেওয়াকেই আঁকুরি পাতা বলে। শিশুদের মঙ্গল কামনায় এই আঁকুরি পাতা হয়। মানভূম বা তার আশেপাশের অঞ্চলে এদিন রাতে পাড়া-প্রতিবেশির কলা-মূলো-ফল-শব্জী ইত্যাদি চুরি করার প্রথা আছে। একে স্থানীয় ভাষায় 'চোখচান্দা' বা 'চোখছেন্দা' বলা হয়। 

এটি আসলে সূর্য ও ইন্দ্রের সাথে জড়িত বলে কৃষি উৎসবও বলা যেতে পারে। আখ, ধানের গাছ , ও বটের ডাল ইত্যাদি বেঁধে নদী বা পুকুরের ঘাটে পুজো হয়। অনেকে উঠোনে গর্ত করেও এই পুজো করেন। সেখানে থাকে শেয়াল শকুন। এই দুই প্রাণীকে অশুভ মনে করা হয় বলেই এই শেয়ল শকুনিকে দূরে পাঠিয়ে  শিশুদের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। এ

শেয়াল শকুনদের লোকালয় থেকে দূরে যেত বলে মহিলারা বলেন --
   শকুন গেল ডালে
  শেয়ল গেল খালে। 

ব্রতেরদিন বাড়ির উঠোনে বা যে কোনও জায়গায় ডাঁটশুদ্ধ শালুকফুল, আখগাছ, ধানের চারা, বটগাছের ডাল ইত্যাদি  দিয়ে জীমুতবাহনের প্রতীষ্ঠা করা হয়। গলায় দেওয়া হয় শালুক ফুলের মালা। গড়া হয়, শিয়াল-শকুনের মাটির মূর্তি। তাদের গায়ে একটি হলুদে ডোবান কাপড় দেওয়া হয়। 

সারারাত ঘি- এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয় সন্তানদের মঙ্গল কামনায়। এরপর ওই প্রদীপে কাজল পেড়ে ছেলেমেয়েদের পরানো হয়। কোথাও কোথাও আবার ভেলার টিপও দেওয়া হয় নজরদোষ এড়ানোর জন্য । এই ভেলা খুবই এলার্জিকারক বলে এলার্জির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই টিপ দেওয়া হয় বলে ধারণা।  পান্নার দিন প্রসাদের মটর, ছোলা, কলাই, পুঁইশাক, জিঙা, শশা, আলু দিয়ে একটি বিশেষ পদ রান্না করা হয় । 

ব্রতীরা পুকুরপাড়ে  বা নদীতে ডালগুলি এবং মাটির শেয়াল শকুনকে জলে বিসর্জ্জন দিয়ে স্নান দই চিড়া দিয়ে পান্না (উপবাস ভঙ্গ ) করেন। 

জীমূতবাহনের ধ্যান :
     শ্রী মজ্জীমূত বাহনং সুরপতিং দিব্যাঙ্গনা সেবিতং
    শল্যগ্রাম বিনিস্মিতং সুনিয়তং বজ্রং দধানং করে ।
    দৈবাদৈঃ পরিবেষ্টিতং সুচরিতং পদ্মাসনে ধ্যানগং 
   সত্যং যা পুরুষোত্তমং শশীনিভং তং দেবরাজং ভজে ।।

জীমূতবাহনের স্তুতি:

ঔঁ পুরন্দর নমস্তেঽস্তু বজ্রহস্ত নমোঽস্তুতে।
শচীপতে নমস্তুভ্যং নমস্তে শালিবাহন।।
ঐরাবত সন্নিষন্ন সহস্রাক্ষ মহাকায়।
নৌমি ত্বাং  জীমুতাধীশ কৃপাদৃষ্টি প্রদো ভব।।

জীমূতবাহনের প্রণাম মন্ত্র :

নমামি ত্বাং সুরপতে প্রভো জীমুত বাহন।
বালকং রক্ষ রক্ষ শরণং ত্বাং ব্রজামহে।।

এটা প্রচলিত আছে যে  জিতার ডালায় দুর্গা আসে । কৃষ্ণ নবমীকল্পে আগামীকাল এই দুর্গার বোধন । অর্থাৎ অলিখিত দুর্গা পুজো শুরু হয়ে গেল । 

ব্রতকথা:-

পুরাকালে চন্দ্রভানু নামে এক রাজার রাজ্যে ধর্মদাস নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। সেই ব্রাহ্মণের তেজবতী নামে এক পরমাসুন্দরী কন্যা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে তেজবতীর এক কুলিন পাত্রের সঙ্গে বিবাহ হয়। কিন্তু ভাগ্যের নিঠুর পরিহাসে সেই পাত্র মারা গেলে অকালেই বিধবা হয় তেজবতী। 
এক বর্ষাকালে রাজা চন্দ্রভানুর পিতার শ্রাদ্ধের জন্য আতপ চালের সঙ্কট দেখা দেয়। আতপ চাল সূর্যের রোদ ছাড়া তৈরি করা অসম্ভব। এদিকে সারাদিন মেঘের আড়ালে সূর্য রয়েছেন। এমতাবস্থায় রাজা ঘোষণা করেন, যে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজাকে আতপ চাল এনে দিতে পারবে রাজা তাকে সোনার কলস উপহার দেবে।
সেই ঘোষণা শুনে বিধবা বাহ্মনী তেজবতী আতপ চাল তৈরির মনস্থির করলেন। কিন্তু সূর্যের আলো কি ? তখন তিনি আতপ চাল তৈরির জন্য সূর্যদেবের প্রার্থনা শুরু করলেন।
সূর্যদেব তার ডাকে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে তার মনোবাসনা জানাতে বললেন। তখন তেজবতী প্রার্থনা করলেন যে, তিনি যেন তার গৃহে অবস্থান করেন, যাতে সে সূর্যদেবের তেজরশ্মি দ্বারা আতপচাল তৈরি করতে পারে।
তখন সূর্যদেব বললেন, যদি সে সূর্যদেবকে পতিরূপে গ্রহণ করে তবেই তিনি তার গৃহে অবস্থান করবেন। প্রথমে তেজবতী এই কথা শুনে অবাক হলেও উপায়ান্তর না দেখে রাজি হলেন।
এবার কথা মত সূর্যদেব তেজবতীর গৃহে অবস্থান করলেন এবং তেজবতী আতপচাল তৈরি করলেন। সূর্যদেব পরদিন প্রভাতে বিছানা ত্যাগ করার পূর্বে তার তেজকিরণের অংশ দ্বারা পুঁইশাক সৃষ্টি করলেন। এবং তার গৃহ ত্যাগ করলেন। তেজবতী রাজার কাছে আতপ চাল পৌঁছে দিয়ে এসে দেখলেন যে বিছানার উপর একটি পুঁইশাক রয়েছে।
পরদিন ছিল দ্বাদশী। সেদিন পুঁইশাক ভক্ষণ করলেন সেই বিধবা ব্রাহ্মণী। আর এই ভক্ষণের ফলশ্রুতিতে তেজবতী গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। 
অচিরেই এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজা এই সংবাদ শুনে তেজবতীকে সুশ্চরিত্রা ভেবে বন্দী করলেন। 
রাত্রিতে স্বপ্নাদেশে রাজা দেখলেন যে, হংসবাহনে চড়ে জটাধারী এক দিব্যপুরুষ তাকে বলছেন যে, “ হে রাজন তুমি ভুল করছ। তুমি ভুল করছ তেজবতীকে দুশ্চরিত্রা ভেবে বন্দী করে। এ এক দিব্যলীলা। কাল প্রভাতে তুমি তাকে মুক্ত করে দেবে।“ এই বলে সেই দিব্যপুরুষ অন্তর্ধান হলেন।
পরদিন রাত ভোর হতে না হতেই তেজবতীকে মুক্ত করলেন রাজা।

এর কিছুদিন পর তেজবতী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। সেই সন্তান তেজস্বী, চতুর্বাহু বিশিষ্ট, কানে কুন্ডল এবং মাথায় জটা। তার নাম রাখা হল জীমূতবাহন। 
সময় যায়। জীমূতবাহন বড় হতে থাকে। একদিন পাঠশালায় সকলে তার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করে। জীমূতবাহন ফিরে এসে মায়ের কাছে পিতৃপরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন সূর্যদেব তার পিতা। পিতার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য যে পথে সূর্যদেব উদয়গিরি যান সেই পথে তিনি তার পুত্রকে নিয়ে গেলেন। 

সূর্যদেব যখন সেই পথে রথে করে যাচ্ছেন সেই সময় জীমূতবাহন সূর্যদেবের রথের দড়ি ধরে টান দিলেন। সূর্যদেব তার পরিচয় জানতে চাইলে তেজবতী বললেন যে জীমূতবাহন তার সন্তান। 

কিন্তু সূর্যদেব সব অস্বীকার করলেন। তেজবতী তখন তাকে পূর্বের সব কথা বললেন। সাক্ষী হিসাবে চিল আর শিয়ালীর কথা বললেন। তারাও সমস্ত কথা সূর্যকে জানাল। তাতেও সূর্যদেব মানতে না চাইলে তেজবতী সূর্যকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। এইসময় সূর্য সমস্ত কিছু স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। জীমূতবাহনকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিয়ে বললেন, “দেবতাদের মত তার এই পুত্রেরও মর্ত্যলোকে পূজা হবে, সকল মর্ত্যবাসী বিশেষ করে নারীরা সন্তান লাভ এবং সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনায় আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে সন্ধ্যের পর এই ব্রত পালন করবে। পূজা শেষে রাত্রি জাগরন ও পরদিন পারন পালন করবে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে নিজেরা খাবেন।

জিতাষ্টমীর আরো একটি ব্রতকথা আছে। সেটি হল - 

কোন এক দেশে শালিবাহন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন খুব নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক। তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য থাকলেও ছিল না কোন সন্তান। এই কারণে রাজা আর রানীর মনে সুখ, শান্তি ছিল না। রাজা বহুবার বহু যজ্ঞ করালেন ছেলেমেয়ে হওয়ার জন্যে, কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। কত তাবিজ, কবজ ধারণ করলেন। কিন্তু নাহ ফল কিছুই হল না। দুঃখে ম্রিয়মান রানী একদিন রাতে এক স্বপ্ন দেখলেন, এক দেবতা হাঁসে চড়ে এসে বলছেন, “রানী তুমি জিতাষ্টমীর ব্রত কর। তোমার ছেলেমেয়ে হবে।“ 
পরদিন সকালে রাজাকে রানী সব জানাতে তিনি শুধু মতই দিলেন না সমস্ত আয়োজনও করতে থাকলেন।
ক্রমে এল আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। রাজার আদেশ মত উঠোনে একটি ছোট পুকুর কাটিয়ে তাতে কলাগাছ আর বেল গাছ পুঁতে দিলেন। রানীও ব্রতের প্রথা অনুযায়ী সারাদিন উপোষ থেকে সন্ধ্যের সময় মটর ও ফলের নৈবিদ্য দিয়ে জীমূতবাহনের পুজো করলেন ও নিজে প্রসাদ খেয়ে বাকিদেরও প্রসাদ দিলেন। পরেরদিন সকালে উঠে রানী চান করে আবার সেই পুকুরের কাছে গিয়ে নিয়মিত পুজো করলেন সন্তান কামনায়। 

এর কিছুদিন পর রাজা আর রানীর এক ছেলে আর এক মেয়ে হল। শালিবাহন ছেলের নাম রাখলেন জীমূতবাহন আর মেয়ের নাম সুশীলা। 

দিন যায়। জীমূতবাহন বিবাহযোগ্য হলে এক সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। বউটি ভালো হল বটে কিন্তু একটি বিষয়ে দুঃখ রয়ে গেল। জীমূতবাহন আর রাজকন্যের কয়েকটি ছেলেমেয়ে হল কিন্তু তারা অকালেই মারা গেল।

এদিকে শাশুড়ি কিন্তু উঠোনে পুকুর কাটিয়ে নিয়মমত জিতাষ্টমীর ব্রত পালন করতে থাকেন। কিন্তু বউটি এসব দেখে শুধু হাসে আর উপহাস করে শাশুড়িকে। এই উপহাসই যে তার সন্তানের মৃত্যুর কারণ সে বুঝতেও পারে না।
এই ভাবে সময় যেতে যেতে আবার এল আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী। শাশুড়ি এবার অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুজিয়ে বউকে রাজি করালো ব্রত করাতে। প্রথমে হাসি আর উপোষ করতে পারবে না বললেও শেষে সে রাজি হল ব্রত করতে। ব্রত শেষে সে সন্তান কামনা করল।
কিছুদিন পর সে গর্ভবতী হল। নির্দিষ্ট সময়ে তার এক ছেলে হল। এরপর তার সমস্ত ছেলেমেয়ে বেঁচে থাকল এই ব্রতের কারনে

                                 - - -



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন