শুক্রবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২১

কার্তিক পুজো

         
          ( আরও দেখুন - সূচিপত্র
         বাংলা কার্তিক মাসের সংক্রান্তির দিন পুজা করা হয় দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়র। দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়  ভগবান শিবের পুত্র । তারকাসুর বর পেয়েছিলেন যে ভগবান শিবের পুত্র ছাড়া আর কারোর হাতেই তিনি নিহত হবেন না। সে উদ্দেশ্যে কামদেব যান লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে তপস্যালীণ শিবের তপোভঙ্গ করতে। 
ঘটনাক্রমে এসময় ভগবান শিবের জন্য তপস্যা করছিলেন হিমালয় কন্যা পার্বতী। মদনদেব শিবের তপোভঙ্গ করলে পার্বতীর সাথে শিবের মিলন হয়। আর শিববীর্য ধারন করেন পার্বতী। কিন্তু ভগবান শিবের সেই জ্বলন্ত সূর্য সমান বীর্য পার্বতীর পক্ষে ধারন করা অসম্ভব হলে তিনি তা অগ্নিদেবকে প্রদান করেন। অগ্নিদেবও তা ধারন করতে না পেরে শরবনে নিক্ষেপ করেন। সেখানেই কার্তিকের জন্ম হয়।
কৃত্তিকাগণ মানুষ করেন বলে নাম হয় কার্তিক বা কার্ত্তিকেয়। এছাড়াও তাকে একাধিক নামে ডাকা হয়। যথা - কৃত্তিকাসূত, অম্বিকেয়া, নমুচি, স্কন্দ, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুল্য, ক্রোণারতী, শরাজ, তারকারি, শক্তিপাণি, বিশাখা, সরণান, গুহ, শান্তমাতুর, কুমার, সৌর্সেন, দেবসেনাপতি গৌরী সুত ইত্যাদি।
কার্তিকের স্ত্রী হলেন দেবসেনা এবং বালি (বলি)। সুরপাদমানকে হত্যা করার পরে দেবরাজ ইন্দ্র কার্তিককে তাঁর কন্যা দেবসেনের সাথে বিবাহ করেছিলেন। কার্তিক পরে নাম্বিরাজের মেয়ে বালিকে বিয়ে করেছিলেন।

দেবসেনাপতি কার্তিক দক্ষিণ ভারতে প্রসিদ্ধ । তামিল বিশ্বাস অনুসারে, মুরুগান হলেন তামিলনাড়ুর রক্ষক। এছাড়াও  সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া এবং মরিশাসে যেখানে তামিল জাতিগোষ্ঠী প্রভাব রয়েছে সেখানে মুরুগান খুব জনপ্রিয়। 
তামিল ও মালায়ালামে তিনি  মুরুগান বা ময়ূরী স্কন্দস্বামী (তামিল: முருகன், মালায়ালাম: മുരുകൻ) নামে পরিচিত।  কন্নড় ও তেলেগুতে তিনি সুব্রহ্মণ্যম (কন্নড়: ಸುಬ್ರಹ್ಮಣ್ಯ, তেলেগু: స్వామి స్వామి‍) ।  শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে কার্তিকেয়কে উত্সর্গীকৃত কাঠারগাম  মন্দিরে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরাই উপাসনার জন্য হাজির হয় । 

কার্তিক পূজার মন্ত্র :-ও


ওঁ কার্ত্তিকেয়ং মহাভাগং ময়ুরোপরিসংস্থিতম্।
তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং শক্তিহস্তং বরপ্রদম্।।
দ্বিভুজং শক্রহন্তারং নানালঙ্কারভূষিতম্।
প্রসন্নবদনং দেবং কুমারং পুত্রদায়কম্।।

ওঁ কার্ত্তিকের মহাভাগ দৈত্যদর্পনিসূদন।
প্রণোতোহং মহাবাহো নমস্তে শিখিবাহন।
রুদ্রপুত্র নমস্ত্তভ্যং শক্তিহস্ত বরপ্রদ।
ষান্মাতুর মহাভাগ তারকান্তকর প্রভো।
মহাতপস্বী ভগবান্ পিতুর্মাতুঃ প্রিয় সদা।
দেবানাং যজ্ঞরক্ষার্থং জাতস্ত্বং গিরিশিখরে।
শৈলাত্মজায়াং ভবতে তুভ্যং নিত্যং নমো নমঃ।

প্রণাম মন্ত্র:-

ওঁ কার্ত্তিকের মহাভাগ দৈত্যদর্পনিসূদন। প্রণোতোহং মহাবাহো নমস্তে শিখিবাহন। রুদ্রপুত্র নমস্ত্তভ্যং শক্তিহস্ত বরপ্রদ।


বর্ণনা:-

           পৌরাণিক বর্ননা অনুসারে দেবসেনাপতি কার্তিকেয়র গাত্র হলুদবর্ণের। তার ছয়টি মাথা, তাই তিনি ষড়ানন বলে খ্যাত । পাঁচটি ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান, নাক, জিভ ও ত্বক ছাড়াও একাগ্র মন দিয়ে তিনি যুদ্ধ করেন বলেই তিনি ষড়ানন ।  তার বাহন ময়ূর। সৌন্দর্য এবং শৌর্য এই দুটি বৈশিষ্ট্যই ময়ূরের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর হাতে থাকে বর্শা-তীর-ধনুক। তিনি চিরকুমার । তবে কিছু কিছু পৌরাণিক বর্ণনাতে  তাঁর বিবাহের উল্লেখও পাওয়া গেছে। কারো মতে মানব জীবনের ষড়রিপু- কাম(কামনা), ক্রোধ (রাগ), লোভ(লালসা),মদ(অহং), মোহ (আবেগ), মাত্সর্য্য (ঈর্ষা)কে সংবরণ করে দেব সেনাপতি কার্তিক যুদ্ধক্ষেত্রে সদা সজাগ থাকেন।

লোকাচার:-

মা ষষ্ঠী কার্তিকেয়র স্ত্রী। কথিত আছে তারকাসুরের হাত হতে মা ষষ্ঠীই শিশু কার্তিকেয়কে রক্ষা করেন। এজন্যই মা ষষ্ঠী শিশুদের রক্ষাকর্ত্রী বলে মানা হয় ৷ আর কথিত আছে কার্তিক ঠাকুরের কৃপা পেলে পুত্রলাভ এবং ধনলাভ হয়। সেজন্য সদ্য বিয়ে হয়েছে অথবা বিয়ের এক বছর হয়ে গেছে কিন্তুু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা একটি জনপ্রিয় লোকাচারের মধ্যে পড়ে ।

বর্ধমানের কাটোয়ার কার্তিক পুজো এত বিখ্যাত তাই এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে। একে কার্তিক লড়াই বলা হয়  । কার্তিকেয়কে  নিয়ে এই বাংলায় প্রচলিত আছে  বহু ছড়া। এদের মধ্যে পরিচিত একটি হল –

“কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, একবার আসেন মায়ের সাথে, একবার আসেন একলা।”


সোমবার, ১৮ অক্টোবর, ২০২১

অষ্টলক্ষ্মী

      

( আরও দেখুন - কোজাগরী লক্ষীপুজা, * লক্ষ্মী দেবীর ব্রতকথা
           মা লক্ষ্মীর আটটি রূপ। 
  • আদিলক্ষ্মী  বা মহালক্ষ্মী  : এটি লক্ষ্মীর আদিরূপ।  মহর্ষি ভৃগুর কন্যারূপে লক্ষ্মীর অবতার তাই তিনি 'সাগরকন্যা' নামেও পরিচিতা। সমুদ্র মন্থনের সময় এই আদিলক্ষ্মী প্রকটিত হন এবং শ্রীবিষ্ণুকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নেন। 
  • ধনলক্ষ্মী : এই লক্ষ্মী অর্থ ও স্বর্ণদাত্রী । তিনি সাধককে সকল বৈষয়িক সুখ ও সমৃদ্ধি প্রদান করেন।
  • ধান্যলক্ষ্মী : কৃষিসম্পদদাত্রী লক্ষ্মী, যিনি কৃষকের গৃহে নবান্নে ধান্যলক্ষ্মীরূপে পূজিতা হন। 
  • গজলক্ষ্মী : গবাদি পশু ও হস্তীআদি সম্পদদাত্রী লক্ষ্মী। এছাড়াও এই গবাদিপশু পালন থেকে যে আয় হয়, তাও গজলক্ষ্মীর কৃপা বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। গজলক্ষ্মী রাজক্ষমতাও প্রদান করেন। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, গজলক্ষ্মী দেবরাজ ইন্দ্রকে সমুদ্রগর্ভ থেকে তার হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এছাড়াও গজ অর্থাৎ হাতিদের দ্বারা পূজিত বলে তিনি গজলক্ষ্মী নামে পরিচিতা ।
  • সন্তানলক্ষ্মী : সন্তানসুখপ্রদায়িত্রী লক্ষ্মী।
  • বীরলক্ষ্মী  বা ধৈর্যলক্ষ্মী : যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব এবং জীবনের কঠিন সময়ে সাহস প্রদানকারী লক্ষ্মী হলেন বীরলক্ষ্মী বা ধৈর্যলক্ষ্মী । 
  • বিজয়লক্ষ্মী  বা জয়লক্ষ্মী  : বিজয় প্রদানকারিনী লক্ষ্মী, কেবলমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়  বরং জীবনের কঠিন সময়ে বাধাবিপত্তি জয় করে সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রেও বিজয়ালক্ষ্মী গুরুত্বপূর্ণ দেবী।
  • বিদ্যালক্ষ্মী : কলা ও বিজ্ঞানের জ্ঞান রূপ ধন প্রদানকারিনী লক্ষ্মী।
  • অষ্টলক্ষ্মী স্তোত্রম্ :-
       আদিলক্ষ্মী
    সুমনসবন্দিত সুন্দরি মাধবি
         চন্দ্র সহোদরি হেমময়ে।
    মুনিগণমণ্ডিত মোক্ষপ্রদায়িনী
         মঞ্জুলভাষিণী বেদনুতে ।
    পঙ্কজবাসিনী দেবসুপূজিত
         সদ্গুণবর্ষিণী শান্তিযুতে ।
    জয়জয় হে মধুসূদন কামিনি
         আদিলক্ষ্মি সদা পরিপালয় মাম্ ।।১।।

       ধান্যলক্ষ্মী 
    অহিকলি কল্মষনাশিনী কামিনী
         বৈদিকরূপিণী বেদময়ে ।
    ক্ষীরসমুদ্ভব মঙ্গলরূপিণি
         মন্ত্রনিবাসিনি মন্ত্রনুতে ।
    মঙ্গলদায়িনী অম্বুজবাসিনী
         দেবগণাশ্রিত পাদযুতে .
    জয়জয় হে মধুসূদন কামিনী
         ধান্যলক্ষ্মি সদা পালয মাম্ ।।২।। 

       ধৈর্যলক্ষ্মী 
    জয়বরবর্ণিনী বৈষ্ণবি ভার্গবী
         মন্ত্রস্বরূপিণী মন্ত্রময়ে ।
    সুরগণপূজিত শীঘ্রফলপ্রদ
         জ্ঞানবিকাসিনী শাস্ত্রনুতে ।
    ভবভযহারিণি পাপবিমোচনি
         সাধুজনাশ্রিত পাদযুতে ।
    জয়জয় হে মধুসূদন কামিনী
         ধৈর্যলক্ষ্মি সদা পালয় মাম্ ।।৩।। 

       গজলক্ষ্মী 
    জয়জয় দুর্গতিনাশিনী কামিনী
         সর্বফলপ্রদ শাস্ত্রময়ে ।
    রথগজ তুরগপদাদি সমাবৃত
         পরিজনমণ্ডিত লোকনুতে ।
    হরিহর ব্রহ্ম সুপূজিত সেবিত
         তাপনিবারিণি পাদযুতে।

       জয় জয় হে মধুসূদন কামিনী 
                গজলক্ষ্মি রূপেণ পালয মাম্ ।।৪।।

   সন্তানলক্ষ্মী 
অহিখগ বাহিনী মোহিনী চক্রিণী
     রাগবিবর্ধিনী জ্ঞানময়ে। 
গুণগণবারিধি লোকহিতৈষিণী
     স্বরসপ্ত ভূষিত গাননুতে। 
সকল সুরাসুর দেবমুনীশ্বর
     মানববন্দিত পাদযুতে ।
জয়জয় হে মধুসূদন কামিনি
     সন্তানলক্ষ্মি ত্বং পালয় মাম্ ।।৫।। 

    বিজয়লক্ষ্মী 
জয় কমলাসনী সদ্গতিদায়িনী
     জ্ঞানবিকাসিনী গানময়ে ।
অনুদিনমর্চিত কুঙ্কুমধূসর-
     ভূষিত বাসিত বাদ্যনুতে। 
কনকধরাস্তুতি বৈভব বন্দিত
     শঙ্কর দেশিক মান্য পদে। 
জয়জয় হে মধুসূদন কামিনী
     বিজয়লক্ষ্মি সদা পালয় মাম্ ।।৬।। 

   বিদ্যালক্ষ্মী
প্রণত সুরেশ্বরি ভারতি ভার্গবী
     শোকবিনাশিনী রত্নময়ে
মণিময়ভূষিত কর্ণবিভূষণ
     শান্তিসমাবৃত হাস্যমুখে ।
নবনিধিদায়িনী কলিমলহারিণী
     কামিত ফলপ্রদ হস্তযুতে ।
জয়জয় হে মধুসূদন কামিনী
     বিদ্যালক্ষ্মি সদা পালয় মাম্ ।।৭।। 

   ধনলক্ষ্মী
ধিমিধিমি ধিন্ধিমি ধিন্ধিমি দিন্ধিমী
     দুন্দুভি নাদ সুপূর্ণময়ে। 
ঘুমঘুম ঘুঙ্ঘুম ঘুঙ্ঘুম ঘুঙ্ঘুম
    শঙ্খনিনাদ সুবাদ্যনুতে ।
বেদপুরাণেতিহাস সুপূজিত
     বৈদিকমার্গ প্রদর্শযুতে .
জয়জয় হে মধুসূদন কামিনী
     ধনলক্ষ্মি রূপেণ পালয় মাম্ ।।৮।। 


বৃহস্পতিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২১

নবদুর্গা

নবদুর্গা 

(আরও পড়ুন  -  সূচিপত্র  * বিজয়া *) 
শৈলপুত্রী : প্রতিপদের দিন দেবী শৈলপুত্রী । হিমালয়ের কন্যা হিসেবে  শৈলশিখরে জন্মগ্রহণ করেন  বলে তিনি শৈলপুত্রী নামে খ্যাত। দেবী পূর্ব জন্মে ছিলেন দক্ষ নন্দিনী সতী  । দক্ষের অমতে তিনি শিব কেই বিবাহ করেন।  দক্ষ এক শিব হীন যজ্ঞের আয়োজন করলে দেবী সতী বিনা নিমন্ত্রণে পিত্রালয়ে গিয়ে অনেক অপমানিত হলেন ও যজ্ঞের আগুনে আত্মাহুতি দেন।   ভগবান শিব সতীর শোকে তাণ্ডব শুরু করেন। দক্ষ যজ্ঞ ধ্বংস হয় । এই দেবীই  পর জন্মে হিমালয় কন্যা পার্বতী রূপে জন্ম নেন।
শুক্লপক্ষের প্রতিপদে বিল্বপত্র, জবা, মিষ্টান্ন, ফল, নৈবদ্য ইত্যাদি বিভিন্ন উপাচার অর্পণ করে মায়ের পূজা করা হয়। 
দেবী শৈলপুত্রীর  বাঁহাতে থাকে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল আর মাথায় থাকে অর্ধচন্দ্র। দেবীর ডানহাতে থাকে ত্রিশূল,  বাহন বৃষ। দেবী মঙ্গলময়ী, ভক্তবৎসলা। দেবী সন্তুষ্টা হলে ভক্তকে সমস্ত বিপদ, ভয় থেকে সর্বদা রক্ষা করেন।

ধ্যানং (মূলাধারচক্র ) :
বন্দে বাঞ্ছিতলাভায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
বৃষারূঢাং শূলধরাং শৈলপুত্রীং য়শস্বিনীম্ ॥
পূর্ণেন্দুনিভাঙ্গৌরীং মূলাধারস্থিতাং প্রথমদুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
পটাম্বরপরিধানাং রত্নকিরীটাং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ॥
প্রফুল্লবদনাং পল্লবাধরাং কান্তকপোলাং তুঙ্গকুচাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যস্নেহমুখীং ক্ষীণমধ্যাং নিতম্বনীম্ ॥

স্তোত্রম্ -
প্রথমদুর্গা ত্বং হি ভবসাগরতারিণী ।
ধন ঐশ্বর্যদায়িনী শৈলপুত্রী প্রণমাম্যহম্ ॥
ত্রিলোকজননী ত্বং হি পরমানন্দপ্রদায়িনী ।
সৌভাগ্যারোগ্যদায়নী শৈলপুত্রী প্রণমাম্যহম্ ॥
চরাচরেশ্বরী ত্বং হি মহামোহবিনাশিনী ।
ভুক্তিমুক্তিদায়নী শৈলপুত্রী প্রণমাম্যহম্ ॥

কবচম্ -
ওঙ্কারঃ মে শিরঃ পাতু মূলাধারনিবাসিনী ।
হ্রীঙ্কারঃ পাতু ললাটে বীজরূপা মহেশ্বরী ॥
শ্রীকারঃ পাতু বদনে লজ্জারূপা মহেশ্বরী ।
হূঙ্কারঃ পাতু হৃদয়ে তারিণী শক্তিঃ স্বধৃতা ॥
ফট্কারঃ পাতু সর্বাঙ্গে সর্বসিদ্ধিফলপ্রদা ।

২ ব্রহ্মচারিণী : দ্বিতীয়ার দিন দেবী ব্রহ্মচারিণী। শিবকে পাওয়ার জন্য  তপস্বিনী রূপে তপস্যা করেন দেবী । গাছ থেকে পড়া পাতাটিও খেতেন না বলে তাকে অপর্ণাও বলা হতো।
 ‘বেদস্তত্ত্বং তপো ব্রহ্ম’ - অর্থাৎ বেদ, তত্ত্ব এবং তপ হল ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ।  ব্রহ্ম শব্দের অর্থ তপস্যা। ব্রহ্মচারিণী অর্থাৎ তপশ্চারিণী বা তপ আচরণকারিণী এই দেবীর এই দেবীর রূপ জ্যোতিতে পূর্ণ, অতি মহিমামণ্ডিত।দেবীর  বাঁহাতে থাকে কমণ্ডল এবং অঙ্গভূষণ হল রুদ্রাক্ষ। তাঁর ডানহাতে থাকে পদ্মফুল। নারদের পরামর্শে শিবকে পতিরূপে লাভ করার জন্য তিনি কঠিন তপস্যা করেন। তাই, তাকে তপশ্চারিণী বা ব্রহ্মচারিণী বলা হয়।

 ব্রহ্মচারিণী (স্বাধিষ্ঠানচক্র):

দধানা  করপদ্মাভ্যামক্ষমালাকমণ্ডলূ ।
দেবী প্রসীদতু ময়ি ব্রহ্মচারিণ্যনুত্তমা ॥

ধ্যানং -
বন্দে বাঞ্ছিতলাভায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
জপমালাকমণ্ডলুধরাং ব্রহ্মচারিণীং শুভাম্ ।
গৌরবর্ণাং স্বাধিষ্ঠানস্থিতাং দ্বিতীয়দুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
ধবলবর্ণাং ব্রহ্মরূপাং পুষ্পালঙ্কারভূষিতাম্ ।
পদ্মবদনাং পল্লবাধরাং কান্তঙ্কপোলাং পীনপয়োধরাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যাং স্মেরমুখীং নিম্ননাভিং নিতম্বনীম্ ॥

স্তোত্রং -
তপশ্চারিণী ত্বং হি তাপত্রয়নিবারিণী ।
ব্রহ্মরূপধরাং ব্রহ্মচারিণীং প্রণমাম্যহম্ ॥
নবচক্রভেদিনী ত্বং হি নব ঐশ্বর্যপ্রদায়িনী ।
ধনদাং সুখদাং ব্রহ্মচারিণীং প্রণমাম্যহম্ ॥
শঙ্করপ্রিয়া ত্বং হি ভুক্তি-মুক্তিদায়িনী ।
শান্তিদাং মানদাং ব্রহ্মচারিণীং প্রণমাম্যহম্ ।।

কবচম্ -
ত্রিপুরা মে হৃদয়ং পাতু ললাটং পাতু শঙ্করভামিনী
অর্পণা সদা পাতু নেত্রৌ অধরৌ চ কপোলৌ ॥
পঞ্চদশী কণ্ঠং পাতু মধ্যদেশং পাতু মাহেশ্বরী
ষোডশী সদা পাতু নভো গৃহো চ পাদয়ো ।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গং সততং পাতু ব্রহ্মচারিণী ॥

৩ চন্দ্রঘন্টা :  মহাতৃতীয় দিন দেবী চন্দ্রঘন্টা। দেবীর মাথায় অর্ধচন্দ্র থাকে ও  দেবীর মুখ চাঁদের মতোই সুন্দর ও স্নিগ্ধ আলোয় উজ্জ্বল, তাই, দেবীর নাম ‘চন্দ্রঘণ্টা’ । তাঁর দর্শনেই সকলের মন ভালো হয়ে যায়। এই রূপে দেবী যুদ্ধোদ্যত। ভক্তদের রক্ষা করতে দশভুজা দেবীর আটটি হাতে অস্ত্রধারণ করেছেন ও বাকি দুহাতে বরাভয় মুদ্রা। তাঁর মস্তকে থাকে অর্ধচন্দ্র, হাতে থাকে কমণ্ডল, তরোয়াল, গদা, ত্রিশূল, ধনুর্বাণ, পদ্ম, জপমালা এবং তাঁর শরীরের রং সোনার মতো উজ্জ্বল। 
শিব পার্বতীর বিবাহের সময় তারকাসুর প্রেরিত দৈত্য ও দানবদের তাড়াতে পার্বতীর শরীর হতে এই সিংহবাহনা দেবী উৎপন্ন হন । দেবী তাঁর ঘণ্টার ন্যায় প্রচণ্ড ধ্বনিতে দুরাচার দানব ও  দৈত্যদের প্রকম্পিত করে। ত্রিনয়নী দেবী খুবই মোহময়ী ও উজ্জ্বল।

চন্দ্রঘণ্টা -(মণিপুরচক্র)

পিণ্ডজপ্রবরারূঢা চন্দ্রকোপাস্ত্রকৈর্যুতা ।
প্রসাদং তনুতাং মহ্যং চন্দ্রঘণ্টেতি বিশ্রুতা ॥

ধ্যানং -
বন্দে বাঞ্ছিতলাভায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
সিংহারূঢাং দশভুজাঞ্চন্দ্রঘণ্টাং য়শস্বনীম্ ॥
কঞ্জনাভাং মণিপুরস্থিতাং তৃতীয়দুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
খড্গগদাত্রিশূলচাপধরাং পদ্মকমণ্ডলুমালাবরাভয়করাম্ ।
পটাম্বরপরিধানাং মৃদুহাস্যাং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
মঞ্জীর-হার-কেয়ূর-কিঙ্কিণীরত্নকুণ্ডলমণ্ডিতাম্ ॥
প্রফুল্লবন্দনাং বিম্বাধারাং কান্তঙ্কপোলাং তুঙ্গকুচাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যাং ক্ষীণকটিং নিতম্বনীম্ ॥

স্ত্রোত্রঃ-
আপদুদ্ধারিণী ত্বং হি আদ্যাশক্তিঃ শুভা পরা ।
অণিমাদিসিদ্ধিদাত্রি চন্দ্রঘণ্টে প্রণমাম্যহম্ ॥
চন্দ্রমুখী ইষ্টদাত্রী ইষ্টমন্ত্রস্বরূপণী ।
ধনদাত্র্যানন্দদাত্রী চন্দ্রঘণ্টে প্রণমাম্যহম্ ॥
নানারূপধারিণী ইচ্ছাময়ী ঐশ্বর্যদায়নী ।
সৌভাগ্যারোগ্যদায়নী চন্দ্রঘণ্টে প্রণমাম্যহম্ ॥

কবচঃ-
রহস্যং শৃণু বক্ষ্যামি শৈবেশি কমলাননে ।
শ্রীচন্দ্রঘণ্টাকবচং সর্বসিদ্ধিপ্রদায়কম্ ॥
বিনা ন্যাসং বিনা বিনিয়োগং বিনা শাপোদ্ধারং বিনা হোমম্ ।
স্নানং শৌচাদিকং নাস্তি শ্রদ্ধামাত্রেণ সিদ্ধিদম্ ॥
কুশিষ্যায় কুটিলায় বঞ্চকায় নিন্দাকায় চ ।
ন দাতব্যং ন দাতব্যং ন দাতব্যঙ্কদাচন ॥

৪ কুষ্মাণ্ডা :  মহাচতুর্থীর দিন দেবী  কুষ্মাণ্ডা । 
  ‘কু’, ‘উষ্ণ’ এবং ‘অণ্ড’ এই তিনটি ভাগে ‘কুষ্মাণ্ডা’ শব্দটিকে ভাগ করা হয়।’কু’ অর্থাৎ স্বল্প, ‘উষ্ণ’ অর্থাৎ গরম এবং ‘অণ্ড’ অর্থাৎ বিশ্বজগৎকে বোঝানো হয়েছে। দেবী নিজ হাসি এবং হাতের পাত্রের রক্ত দিয়ে সৃষ্টি করেন আলোকিত ব্রহ্মাণ্ড। এই রূপে দেবীর গাত্রবর্ণ সূর্যের কিরোনের মতো উজ্জ্বল। আটিট হাত দেবী কমণ্ডলু, ধনুক, বাণ, পদ্ম, অমৃতকলস, চক্র, গদা এবং জপমালা ধারণ করে আছেন । অমৃত এখানে ব্রহ্মের রূপক। দেবী অমৃতপূর্ণ কলস অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানের আধার হাতে নিয়ে বসে রয়েছেন। যোগ্য সাধক আপন তপোবল ও কৃচ্ছ্রতা দ্বারা মহামায়াকে প্রসন্না করতে পারলে তবেই মা সেই অমৃতভাণ্ডের অমৃতধারায় সাধককে স্নান করিয়ে তৃপ্ত করবেন অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান প্রদানে কৃতার্থ করবেন। 
এই দেবী কৃষ্ণমাণ্ড নামেও পরিচিতা। ভীমা পর্বতে দেবীর অবস্থান। 

 কূষ্মাণ্ডা (অনাহতচক্র)

সুরাসম্পূর্ণকলশং রুধিরাপ্লুতমেব চ ।
দধানা হস্তপদ্মাভ্যাং কূষ্মাণ্ডা শুভদাঽস্তু মে ॥

ধ্যানং -
বন্দে বাঞ্ছিতকামর্থং চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
সিংহারূঢামষ্টভুজাং কুষ্মাণ্ডাং চ য়শস্বিনীম্ ॥
ভাস্বরাং ভানুনিভামনাহতস্থিতাং চতুর্থদুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
কমণ্ডলুচাপবাণপদ্মসুধাকলশচক্রগদাজপবটীধরাম্ ॥
পটাম্বরপরিধানাং কমনীয়াং মৃদুহাস্যা নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
মঞ্জীরহারকেয়ূরকিঙ্কিণীরত্নকুণ্ডলমণ্ডিতাম্ ।
প্রফুল্লবদনাং  চারুচিবুকাং কান্তকপোলাং তুঙ্গকুচাম্ ।
কোলাঙ্গীং স্মেরমুখীং ক্ষীণকটিং নিম্ননাভিং নিতম্বনীম্ ॥

স্ত্রোত্রঃ-
দুর্গতিনাশিনী ত্বং হি দারিদ্র্যাদিবিনাশিনী ।
জয়দা ধনদা কূষ্মাণ্ডে প্রণমাম্যহম্ ॥
জগন্মাতা জগত্কর্ত্রি জগদাধাররূপিণী ।
চরাচরেশ্বরী কূষ্মাণ্ডে প্রণমাম্যহম্ ॥
ত্রৈলোক্যসুন্দরী ত্বং হি দুঃখশোকনিবারিণী ।
পরমানন্দময়ী কূষ্মাণ্ডে প্রণমাম্যহম্ ॥

কবচং -
হসরৈ মে শিরঃ পাতু কূষ্মাণ্ডা ভবনাশিনী ।
হসলকরী নেত্রঽথ, হসরৌশ্চ ললাটকম্ ॥
কৌমারী পাতু সর্বগাত্রে বারাহী উত্তরে তথা ।
পূর্বে পাতু বৈষ্ণবী ইন্দ্রাণী দক্ষিণে মম ।
দিগ্দিক্ষু  সর্বত্রৈব কূম্বীজং সর্বদাঽবতু ॥


৫. স্কন্দমাতা : মহাপঞ্চমীর দিন দেবী স্কন্দমাতা। 
  কার্তিকের আরেক নাম ‘স্কন্দ’। পশ্চিমভারতে কার্তিকেয়র মাতা হিসেবে এই ত্রিনয়নী, চারহাতবিশিষ্টা ‘স্কন্দমাতা’ পুজিতা হন। ডানদিকের ওপরে রয়েছেন শিশু কার্তিক  এবং নীচের হাতে রয়েছে প্রস্ফুটিত পদ্ম। এই দেবীর কোনো বাহন নেই, তিনি প্রস্ফুটিত কমলে বসে থাকেন। ছান্দোগ্য উপনিষদে কথিত, জ্ঞানীগণ যাঁর, উদরে জন্মগ্রহণের অভিলাষ করেন, সেই শুদ্ধ দেবীই ‘স্কন্দমাতা’। স্বর্ণোজ্জ্বল গাত্রবর্ণের দেবী পদ্মের ওপর উপবিষ্টা বলে তাঁকে ‘পদ্মসনা’ও বলা হয়।
শিবতেজ অগ্নি ধারন করে শরবনে নিক্ষেপ করেন। আর সেই তেজ হতে ছয় মাথা বিশিষ্ট স্কন্দ বা কার্তিকেয়র জন্ম হয়। এই দেবী স্কন্দমাতাই তাকে লালনপালন করেন। এই স্কন্দই তারকাসুরকে হত্যা করেন। 

 স্কন্দমাতা (বিশুদ্ধচক্র)

সিংহাসনগতা নিত্যং পদ্মাশ্রিতকরদ্বয়া ।
শুভদাস্তু সদা দেবী স্কন্দমাতা য়শস্বিনী ॥

ধ্যানম্ -
বন্দে বাঞ্ছিতকামার্থে চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
সিংহারূঢা চতুর্ভুজা স্কন্ধমাতা য়শস্বনী ॥
ধবলবর্ণা বিশুদ্ধচক্রস্থিতা পঞ্চমদুর্গা ত্রিনেত্রা ।
অভয়পদ্ময়ুগ্মকরাং দক্ষিণ ঊরুপুত্রধরাং ভজেঽম্ ॥
পটাম্বরপরিধানা মৃদুহাস্যা নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
মঞ্জীরহারকেয়ূরকিঙ্কিণীরত্নকুণ্ডলধারিণীম্ ॥
প্রভুল্লবদনাং পল্লবাধরাং কান্তকপোলাং পীনপয়োধরাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যাং চারূত্রিবলীং নিতম্বনীম্ ॥

স্তোত্রম্ -
নমামি স্কন্দমাতরং স্কন্ধধারিণীম্ ।
সমগ্রতত্ত্বসাগরামপারপারগহরাম্ ॥
শশিপ্রভাং সমুজ্জ্বলাং স্ফুরচ্ছশাঙ্কশেখরাম্ ।
ললাটরত্নভাস্করাং জগত্প্রদীপ্তভাস্করাম্ ॥
মহেন্দ্রকশ্যপার্চিতাং সনত্কুমারসংস্তুতাম্ ।
সুরাসুরেন্দ্রবন্দিতাং য়থার্থনির্মলাদ্ভুতাম্ ॥
অতর্ক্যরোচিরূবিজাং বিকার দোষবর্জিতাম্ ।
মুমুক্ষুভির্বিচিন্তিতাং বিশেষতত্ত্বমূচিতাম্ ॥
নানালঙ্কারভূষিতাং মৃগেন্দ্রবাহনাগ্রতাম্ ।
সুশুদ্ধতত্ত্বতোষণাং ত্রিবেদমারভাষণাম্ ॥ ??মার
সুধার্মিকৌপকারিণীং সুরেন্দ্রবৈরিঘাতিনীম্ ।
শুভাং সুপুষ্পমালিনীং সুবর্ণকল্পশাখিনীম্ ॥
তমোঽন্ধকারয়ামিনীং শিবস্বভাবকামিনীম্ ।
সহস্ত্রসূর্যরাজিকাং ধনঞ্জয়োগ্রকারিকাম্ ॥
সুশুদ্ধকালকন্দলাং সুভৃঙ্গকৃন্দমঞ্জুলাম্ ।
প্রজায়িনীং প্রজাবতীং নমামি মাতরং সতীম্ ॥
স্বকর্মধারণে গতিং হরিং প্রয়চ্ছ পার্বতীম্ । ??প্রয়চ্ছ
অনন্তশক্তিকান্তিদাং য়শোঽথ ভুক্তিমুক্তিদাম্ ॥
পুনঃপুনর্জগদ্ধিতাং নমাম্যহং সুরার্চিতাম্ ।
জয়েশ্বরি ত্রিলাচনে প্রসীদ দেবি পাহি মাম্ ॥

কবচম্ -
ঐং বীজালিকা দেবী পদয়ুগ্মধরা পরা ।
হৃদয়ং পাতু সা দেবী কার্তিকেয়য়ুতা সতী ॥
শ্রীং হ্রীং হুং ঐং দেবী পূর্বস্যাং পাতু সর্বদা ।
সর্বাঙ্গ মেং সদা পাতু স্কন্দমাতা পুত্রপ্রদা ॥
বাণবাণামৃতে হুং ফট্ বীজসসমন্বিতা ।
উত্তরস্যাং তথাগ্নে চ বারূণে নৈৠতেঽবতু ॥
ইন্দ্রাণী ভৈরবী চৈবাসিতাঙ্গী চ সংহারিণী ।
সর্বদা পাতু মাং দেবী চান্যান্যাসু হি দিক্ষু বৈ ॥


৬ কাত্যায়নী : মহাষষ্ঠীর দিন দেবী কাত্যায়নী । ঋষি কাত্যায়নের কন্যা বলে নাম হয় কাত্যায়নী।  পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে,   ঋষি কাত্যায়ন একটি একটি কন্যাসন্তান লাভের আশায় দেবীর তপস্যা করেন। দেবী তুষ্ট হয়ে কন্যারুপে জন্মগ্রহণ করেন বলে নাম হয় ‘কাত্যায়নী’। 
অপর একটি মতানুসারে, মহিষাসুরের অত্যাচার অতীষ্ঠ হয়ে  ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর ও অন্যান্য দেবতারা ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সমবেত হন। সেখান তাঁদের তেজ সমবেত হয়ে দেবী কাত্যায়নীর সৃষ্টি হয়। এই দেবীই দশমীর দিন মহিষাসুর বধ করেন। 
 দেবীর আট হাতে রয়েছে আট অস্ত্র । দেবী ত্রিনয়নী ও সিংহবাহিনী।

 কাত্যায়নী (আজ্ঞাচক্র)
চন্দ্রহাসোজ্জ্বলকরা শার্দূলবরবাহনা ।
কাত্যায়নী চ শুভদা দেবী দানবঘাতিনী ॥

ধ্যানম্ -
বন্দে বাঞ্ছিতমনোরথার্থায় চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
সিংহারূঢাং চতুর্ভুজাং কাত্যায়নীং য়শস্বনীম্ ॥
স্বর্ণবর্ণামাজ্ঞাচক্রস্থিতাং ষষ্ঠদুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
বরাভীতকরাং সগপদধরাং কাত্যায়নসুতাং ভজামি ॥
পটাম্বরপরিধানাং স্মেরমুখীং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
মঞ্জীরহারকেয়ুরকিঙ্কিণীরত্নকুণ্ডলমণ্ডিতাম্ ॥
প্রসন্নবদনাং পল্লবাধরাং কান্তকপোলাং তুঙ্গকুচাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যাং ত্রিবলীবিভূষিতনিম্ননাভিম্ ॥

স্তোত্রম্ -
কাঞ্চনাভাং বরাভয়পদ্মধরাং মুকুটোজ্জ্বলাং ।
স্মেরমুখীং শিবপত্নীং কাত্যায়নসুতে নমোঽস্তুতে ॥
পটাম্বরপরিধানাং নানালঙ্কারভূষিতাং ।
সিংহাস্থিতাং পদ্মহস্তাং কাত্যায়নসুতে নমোঽস্তুতে ॥
পরমানন্দময়ী দেবি পরব্রহ্ম পরমাত্মা ।
পরমশক্তি,পরমভক্তি, কাত্যায়নসুতে নমোঽস্তুতে ॥
বিশ্বকর্ত্রীং,বিশ্বভর্ত্রীং,বিশ্বহর্ত্রীং,বিশ্বপ্রীতাম্ ।
বিশ্বচিত্তাং,বিশ্বাতীতাং কাত্যায়নসুতে নমোঽস্তুতে ॥
কাং বীজা, কাং জপানন্দা কাং বীজজপতোষিতা ।
কাং কাং বীজজপাসক্তাং কাং কাং সন্তুতা ॥ ??  কাং বীজজপসংস্তুতাম্
কাঙ্কারহর্ষিণীং কাং কাং ধনদাং ধনমানসাম্ ।
কাং বীজজপকারিণীং কাং বীজতপমানসাম্ ॥
কাং কারিণীং কাং সূত্রপূজিতাং কাং বীজধারিণীম্ ।
কাং কীং কূং কৈং কৌং কঃ ঠঃ ছঃ স্বাহারূপণী ॥

কবচম্ -
কাত্যায়নী মুখং পাতু কাং কাং স্বাহাস্বরূপণী ।
ললাটং বিজয়া পাতু মালিনী নিত্যসুন্দরী ॥
কল্যাণী হৃদয়ং পাতু জয়া চ ভগমালিনী ॥

৭  কালরাত্রি : মহাসপ্তমীর দিন দেবী  কালরাত্রি । দেবী কৃষ্ণবর্ণা ও আলুলায়িতকেশা। তাঁর কন্ঠে বিদ্যুতের মালিকা। ত্রিনয়নী দেবীর শ্বাস-প্রশ্বাসে বেরিয়ে আসে আগুনের হলকা। ভীষণদর্শনা দেবীর তিন হাতে অস্ত্র, এক হাতে ভক্তদের প্রতি বরাভয়। তিনি  সর্বনাশক কালেরও নাশিকা রাত্রি। তিনি বিপদকালে সকল কিছু বিনাশ করেন। তিনি প্রলয়কালকেও বিনাশ করতে পারেন। 
এই রূপেই তিনি কালিকা হিসেবে পূজিত হন। তবে, এই রূপেও দেবী ভক্তের শুভ করেন। তাই, অন্যদিকে তিনি শুভঙ্করী । দেবীর বাহন গদর্ভ বা গাধা ।

 কালরাত্রি (ভানু চক্র)

একবেণীজপাকর্ণপুরাননা খরাস্থিতা ।
লম্বোষ্ঠীকর্ণিকাকর্ণীতৈলাভ্যঙ্গশরীরিণী ॥
বামপাদোল্লসল্লোহলতাকণ্টকভূষণা ।
বর্ধনামূর্ধজা কৃষ্ণা কালরাত্রির্ভয়ঙ্করী ॥

ধ্যানম্ -
করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং চতুর্ভুজাম্ ।
কালরাত্রিং করালীং চ বিদ্যুন্মালাবিভূষিতাম্ ॥
দিব্যলৌহবজ্রখড্গবামাধোর্ধ্বকরাম্বুজাম্ ।
অভয়ং বরদাং চৈব দক্ষিণোর্ধ্বাধঃ পাণিকাম্ ॥
মহামেঘপ্রভাং শ্যামাং তথা চ গর্দভারূঢাম্ ।
ঘোরদংষ্ট্রাকারালাস্যাং পীনোন্নতপয়োধরাম্ ॥
সুখপ্রসন্নবদনাং স্মেরাননসরোরুহাম্ ।
এবং সঞ্চিয়ন্তয়েত্কালরাত্রিং সর্বকামসমৃদ্ধিদাম্ ॥

স্তোত্রম্ -
হ্রীং কালরাত্রিঃ শ্রীং করালী চ ক্লীং কল্যাণী কলাবতী ।
কালমাতা কলিদর্পঘ্নী কপদীংশকৃপন্বিতা ॥
কামবীজজপানন্দা কামবীজস্বরূপিণী ।
কুমতিঘ্নী কুলীনাঽঽর্তিনশিনী কুলকামিনী ॥
ক্লীং হ্রীং শ্রীং মন্ত্রবর্ণেন কালকণ্টকঘাতিনী ।
কৃপাময়ী কৃপাধারা কৃপাপারা কৃপাগমা ॥

কবচম্ -
ওঁ ক্লীং মে হৃদয়ং পাতু পাদৌ শ্রীং কালরাত্রিঃ ।
ললাটং সততং পাতু দুষ্টগ্রহনিবারিণী ॥
রসনাং পাতু কৌমারী ভৈরবী চক্ষুষী মম ।
কটৌ পৃষ্ঠে মহেশানী কর্ণৌ শঙ্করভামিনী ।
বর্জিতানি তু স্থানানি য়ানি চ কবচেন হি ।
তানি সর্বাণি মে দেবী সততং পাতু স্তম্ভিনী ॥

৮ মহাগৌরী : মহাষ্টমীর দিন দেবী  মহাগৌরী ।
 দেবীর এই রূপ নিয়ে অনেক মত প্রচলিত আছে। কারও কারও মতে, হিমালয়কন্যা ছিলেন কৃষ্ণা, আবার কেউ কেউ বলেন, আট বছর বয়সি দেবীর গাত্রবর্ণ শঙ্খ, চাঁদ অথবা জুঁইফুলের মতো সাদা। শুধু গাত্রবর্ণই নয়, তাঁর পরিধেয় বস্ত্র, অলঙ্কারও শ্বেত-শুভ্র। শিবকে স্বামীরূপে কামনা করে কঠোর তপস্যা করেছিলেন দেবী পার্বতী। তাতে তাঁর গায়ের রং কৃষ্ণবর্ণ হয়ে ওঠেন। তখন শিব তাকে গঙ্গাজলে স্নান করান ও দেবী হয়ে ওঠেন গৌরকায়। তার নাম হয় মহাগৌরী । 
দেবীর হাতে থাকে ডমরু। দেবীর বাহন ষাঁড়। দেবী ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা। দেবীর এক হাত শোভিত বরাভয় মুদ্রায়, পদ্ম এবং ত্রিশূল অন্যান্য হাতে শোভিত। প্রচলিত বিশ্বাস, নবরাত্রির অষ্টম রাতে তাঁর পুজো করলে সব পাপ ধুয়ে যায়।

 মহাগৌরী (সোমচক্র)
শ্বেতে বৃষে সমারূঢা শ্বেতাম্বরধরা শুচিঃ ।
মহাগৌরী শুভং দদ্যান্মহাদেবপ্রমোদদা ॥

ওঁ নমো ভগবতি মহাগৌরি বৃষারূঢে শ্রীং হ্রীং ক্লীং হুং ফট্ স্বাহা ।

ধ্যান-
বন্দে বাঞ্ছিতকামার্থং চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
সিংহারূঢাং চতুর্ভুজাং মহাগৌরীং য়শস্বীনীম্ ॥
পুর্ণেন্দুনিভাং গৌরীং সোমবক্রস্থিআতাং অষ্টমদুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
বরাভীতিকরাং ত্রিশূলডমরূধরাং মহাগৌরীং ভজেঽহম্ ॥
পটাম্বরপরিধানাং মৃদুহাস্যাং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
মঞ্জীরহারকেয়ূরকিঙ্কিণীরত্নকুণ্ডলমণ্ডিতাম্ ॥
প্রফুল্লবদনাং পল্লবাধরাং কান্তকপোলাং ত্রৈলোক্যমোহনীম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যাং মৃণালাং চন্দনগন্ধলিপ্তাম্ ॥

স্তোত্রম্ -
সর্বসঙ্কটহন্ত্রী ত্বং ধনৈশ্বর্যপ্রদায়নী ।
জ্ঞানদা চতুর্বেদময়ী মহাগৌরীং প্রণমাম্যহম্ ॥
সুখশান্তিদাত্রীং, ধনধান্যপ্রদায়নীম্ ।
ডমরূবাদনপ্রিয়াং মহাগৌরীং প্রণমাম্যহম্ ॥
ত্রৈলোক্যমঙ্গলা ত্বং হি তাপত্রয়বিনাশিনীং প্রণমাম্যহম্ ।
বরদা চৈতন্যময়ী মহাগৌরীং প্রণমাম্যহম্ ॥

কবচম্ -
ওঙ্কারঃ পাতু শীর্ষে মাং, হ্রীং বীজং মাং হৃদয়ে ।
ক্লীং বীজং সদা পাতু নভো গৃহো চ পাদয়োঃ ॥
ললাটকর্ণৌ হূং বীজং পাতু মহাগৌরী মাং নেত্রঘ্রাণৌ ।
কপোলচিবুকৌ ফট্ পাতু স্বাহা মাং সর্ববদনৌ ॥

৯ সিদ্ধিদাত্রী : নবরাত্রির শেষদিন অর্থাৎ মহানবমীর দিন দেবী  সিদ্ধিদাত্রী । সিংহবাহিনী দেবীর চার হাতে আশীর্বাদী মুদ্রা। তিনি সিদ্ধিদান অরেন অর্থাৎ তাঁর উপসনায় সংসারে আসে সুখ এবং সমৃদ্ধি। সবাইকে বরাভয় দেন এই মাতৃকামূর্তি। দেবী ভগবৎ পুরাণে আছে, স্বয়ং মহাদেব দেবী দুর্গাকে ‘সিদ্ধিদাত্রী’ রূপে পুজো করেছিলেন। সিদ্ধিলাভ করার পরে দেবী মহাশক্তির ইচ্ছায় শিবের দেহের অর্ধেক নারিত্ব লাভ করে, যে কারণে শিব ‘অর্ধনারিশ্বর’ রূপে বিখ্যাত। চতুর্ভুজা, সিংহবাহিনী দেবীর মুখশ্রীতে সর্বদা সন্তুষ্টির ছাপ দেখা যায়। দেবী মোক্ষদান করেন। অনিমা, মহিমা, গরিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রকাম্য, ঈষিত্ব, বশিত্ব— এই আটটি সিদ্ধি দেবী পূরণ করেন। এই রূপে দেবী স্নিগ্ধা, গন্ধর্ব, যক্ষ, অসুর এবং দেবতাদের দ্বারা পূজিত হন।

'সিদ্ধ গন্ধর্ব যক্ষাদ্যৈঃ অসুরৈরমবৈরনি ,সেবামানা সদা ভুয়াৎ সিদ্ধিদা সিদ্ধিদায়িনী ।।'

'ঔং ঐং হ্রীং ক্লীং চামুণ্ডায়ৈ বিচ্চে ঔং সিদ্ধিদাত্রি দেব্যৈ নমঃ।

সিদ্ধিদাত্রী (নির্বাণচক্র)

সিদ্ধগন্ধর্বয়ক্ষাদ্যৈরসুরৈরমরৈরপি ।
সেব্যমানা সদা ভূয়াত্ সিদ্ধিদা সিদ্ধিদায়িনী ॥

ধ্যানম্ -
বন্দে বাঞ্ছিতমনোরথার্থং চন্দ্রার্ধকৃতশেখরাম্ ।
কমলস্থিতাং চতুর্ভুজাং সিদ্ধিদাং য়শস্বনীম্ ॥
স্বর্ণবর্ণনির্বাণচক্রস্থিতাং নবমদুর্গাং ত্রিনেত্রাম্ ।
শঙ্খচক্রগদা পদ্মধরাং সিদ্ধিদাত্রীং ভজেঽহম্ ॥
পটাম্বরপরিধানাং সুহাস্যাং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
মঞ্জীরহারকেয়ূরকিঙ্কিণীরত্নকুণ্ডলমণ্ডিতাম্ ॥
প্রফুল্লবদনাং পল্লবাধরাং কান্তকপোলাং পীনপয়োধরাম্ ।
কমনীয়াং লাবণ্যাং ক্ষীণকটিং নিম্ননাভিং নিতম্বনীম্ ॥

স্তোত্রম্ -
কঞ্জনাভাং শঙ্খচক্রগদাধরাং মুকুটোজ্জ্বলাম্ ।
স্মেরমুখি শিবপত্নি সিদ্ধিদাত্রি নমোঽস্তু তে ॥
পটাম্বরপরিধানাং নানালঙ্কারভূষিতাম্ ।
নলিনস্থিতা নলিনাক্ষী সিদ্ধিদাত্রী নমোঽস্তু তে ॥
পরমানন্দময়ী দেবী পরব্রহ্ম পরমাত্মা ।
পরমশক্তি পরমভক্তি সিদ্ধিদাত্রী নমোঽস্তু তে ॥
বিশ্বকর্ত্রী বিশ্বভর্ত্রী বিশ্বহর্ত্রী বিশ্বপ্রীতা ।
বিশ্বার্চিতা বিশ্বাতীতা সিদ্ধিদাত্রী নমোঽস্তু তে ॥
ভুক্তিমুক্তিকারণী ভক্তকষ্টনিবারিণী ।
ভবসাগরতারিণী সিদ্ধিদাত্রী নমোঽস্তু তে ॥
ধর্মার্থকামপ্রদায়িনী মহামোহবিনাশিনী ।
মোক্ষদায়িনী সিদ্ধিদাত্রী ঋদ্ধিদাত্রী নমোঽস্তু তে ॥

কবচম্ -
ওঙ্কারঃ পাতু শীর্ষে মাং, ঐং বীজং মাং হৃদয়ে ।
হ্রীং বীজং সদা পাতু নভো গৃহো চ পাদয়োঃ ॥
ললাটকর্ণৌ শ্রীং বীজং পাতু ক্লীং বীজং মাং নেত্রঘ্রাণৌ ।
কপোলচিবুকৌ হসৌঃ পাতু জগত্প্রসূত্যৈ মাং সর্ববদনে ॥
নবরাত্রিতে এই নবদুর্গার অর্চনা করা হয়। এরপর আশে বিজয়া দশমী বা দশেরা। সকলকে জানাই শুভ বিজয়ার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

#শুভ_দশেরা

'দশ হরা' (দশেরা) একটি সংস্কৃত শব্দ,
যার অর্থ হল দশটি শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করা। যার অর্থ হল, দশটি অপগুণের বিরুদ্ধে বিজয় অর্জন করা।
আর এই দশটি অপগুণ বা শত্রু হল -
১|অহংকার (Ego)
২|অমানবতা (Cruelty)
৩|অন্যায় (Injustice)
৪|কামবাসনা (Lust)
৫|ক্রোধ (Anger)
৬|লোভ (Greed)
৭|দম্ভ (Over Pride)
৮|ঈর্ষা (Jealousy)
৯|মোহ (Attachment)
১০|স্বার্থপরতা (Selfishness)

©kisholoi.blogspot.com

শুক্রবার, ১ অক্টোবর, ২০২১

জীতাষ্টমী

 জিতাষ্টমী ব্রত

 দুর্গা মহাষ্টমীর আগের অষ্টমী তিথি হল জিতাষ্টমী। জিতাষ্টমীর পরপরই দুর্গাপুজো হয় বলে বলা হয় -'জিতার ডালায় বোধন আসে' । '
'জীতা' শব্দটি এসেছে সংস্কৃত 'জীবিত' শব্দ হতে। মায়েরা তাদের পুত্রকন্যার দীর্ঘায়ু কামনা করে এই ব্রত করেন। ওড়িশাতে আবার এই জিতাষ্টমী দুরকম- পুয়া জিউন্তিয়া বা পুত্র জীবক এবং ভাই জিউন্তিয়া বা ভাই জীবক। একে আবার বড়ষষ্ঠীও বলে। 
এই ব্রত মূলত জীমূতবাহনকে উপলক্ষ্য করে। এই আক্ষরিক অর্থে জীমূতবাহন হলেন মেঘের দেবতা ইন্দ্র ।
অনেকে জীমূতবাহন বলতে ইন্দ্রের কথা মনে করতেই পারেন। কিন্তু এই দেবতা ইন্দ্র নন। ইনি সূর্যপুত্র। ঘোড়ার উপর বসে এক হাতে তার লাগাম টেনে ধরেন আর আরেক হাতে থাকে ঘোড়াকে শাসন করার চাবুক। উজ্জ্বল গৌর বর্ণের এই দেবতা তার ব্রত যারা করেন সেই সমস্ত নিঃসন্তান মানুষদের সন্তান লাভের বর দেন। 
ব্রতের নিয়ম :-
ব্রতের আগেরদিন 'আঁকুরি পাতা' হয়। একটা পাত্রে ছোলা ভিজাতে দেওয়াকেই আঁকুরি পাতা বলে। শিশুদের মঙ্গল কামনায় এই আঁকুরি পাতা হয়। মানভূম বা তার আশেপাশের অঞ্চলে এদিন রাতে পাড়া-প্রতিবেশির কলা-মূলো-ফল-শব্জী ইত্যাদি চুরি করার প্রথা আছে। একে স্থানীয় ভাষায় 'চোখচান্দা' বা 'চোখছেন্দা' বলা হয়। 

এটি আসলে সূর্য ও ইন্দ্রের সাথে জড়িত বলে কৃষি উৎসবও বলা যেতে পারে। আখ, ধানের গাছ , ও বটের ডাল ইত্যাদি বেঁধে নদী বা পুকুরের ঘাটে পুজো হয়। অনেকে উঠোনে গর্ত করেও এই পুজো করেন। সেখানে থাকে শেয়াল শকুন। এই দুই প্রাণীকে অশুভ মনে করা হয় বলেই এই শেয়ল শকুনিকে দূরে পাঠিয়ে  শিশুদের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয়। এ

শেয়াল শকুনদের লোকালয় থেকে দূরে যেত বলে মহিলারা বলেন --
   শকুন গেল ডালে
  শেয়ল গেল খালে। 

ব্রতেরদিন বাড়ির উঠোনে বা যে কোনও জায়গায় ডাঁটশুদ্ধ শালুকফুল, আখগাছ, ধানের চারা, বটগাছের ডাল ইত্যাদি  দিয়ে জীমুতবাহনের প্রতীষ্ঠা করা হয়। গলায় দেওয়া হয় শালুক ফুলের মালা। গড়া হয়, শিয়াল-শকুনের মাটির মূর্তি। তাদের গায়ে একটি হলুদে ডোবান কাপড় দেওয়া হয়। 

সারারাত ঘি- এর প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা হয় সন্তানদের মঙ্গল কামনায়। এরপর ওই প্রদীপে কাজল পেড়ে ছেলেমেয়েদের পরানো হয়। কোথাও কোথাও আবার ভেলার টিপও দেওয়া হয় নজরদোষ এড়ানোর জন্য । এই ভেলা খুবই এলার্জিকারক বলে এলার্জির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এই টিপ দেওয়া হয় বলে ধারণা।  পান্নার দিন প্রসাদের মটর, ছোলা, কলাই, পুঁইশাক, জিঙা, শশা, আলু দিয়ে একটি বিশেষ পদ রান্না করা হয় । 

ব্রতীরা পুকুরপাড়ে  বা নদীতে ডালগুলি এবং মাটির শেয়াল শকুনকে জলে বিসর্জ্জন দিয়ে স্নান দই চিড়া দিয়ে পান্না (উপবাস ভঙ্গ ) করেন। 

জীমূতবাহনের ধ্যান :
     শ্রী মজ্জীমূত বাহনং সুরপতিং দিব্যাঙ্গনা সেবিতং
    শল্যগ্রাম বিনিস্মিতং সুনিয়তং বজ্রং দধানং করে ।
    দৈবাদৈঃ পরিবেষ্টিতং সুচরিতং পদ্মাসনে ধ্যানগং 
   সত্যং যা পুরুষোত্তমং শশীনিভং তং দেবরাজং ভজে ।।

জীমূতবাহনের স্তুতি:

ঔঁ পুরন্দর নমস্তেঽস্তু বজ্রহস্ত নমোঽস্তুতে।
শচীপতে নমস্তুভ্যং নমস্তে শালিবাহন।।
ঐরাবত সন্নিষন্ন সহস্রাক্ষ মহাকায়।
নৌমি ত্বাং  জীমুতাধীশ কৃপাদৃষ্টি প্রদো ভব।।

জীমূতবাহনের প্রণাম মন্ত্র :

নমামি ত্বাং সুরপতে প্রভো জীমুত বাহন।
বালকং রক্ষ রক্ষ শরণং ত্বাং ব্রজামহে।।

এটা প্রচলিত আছে যে  জিতার ডালায় দুর্গা আসে । কৃষ্ণ নবমীকল্পে আগামীকাল এই দুর্গার বোধন । অর্থাৎ অলিখিত দুর্গা পুজো শুরু হয়ে গেল । 

ব্রতকথা:-

পুরাকালে চন্দ্রভানু নামে এক রাজার রাজ্যে ধর্মদাস নামে এক ব্রাহ্মণ বাস করতেন। সেই ব্রাহ্মণের তেজবতী নামে এক পরমাসুন্দরী কন্যা ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে তেজবতীর এক কুলিন পাত্রের সঙ্গে বিবাহ হয়। কিন্তু ভাগ্যের নিঠুর পরিহাসে সেই পাত্র মারা গেলে অকালেই বিধবা হয় তেজবতী। 
এক বর্ষাকালে রাজা চন্দ্রভানুর পিতার শ্রাদ্ধের জন্য আতপ চালের সঙ্কট দেখা দেয়। আতপ চাল সূর্যের রোদ ছাড়া তৈরি করা অসম্ভব। এদিকে সারাদিন মেঘের আড়ালে সূর্য রয়েছেন। এমতাবস্থায় রাজা ঘোষণা করেন, যে এক সপ্তাহের মধ্যে রাজাকে আতপ চাল এনে দিতে পারবে রাজা তাকে সোনার কলস উপহার দেবে।
সেই ঘোষণা শুনে বিধবা বাহ্মনী তেজবতী আতপ চাল তৈরির মনস্থির করলেন। কিন্তু সূর্যের আলো কি ? তখন তিনি আতপ চাল তৈরির জন্য সূর্যদেবের প্রার্থনা শুরু করলেন।
সূর্যদেব তার ডাকে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে তার মনোবাসনা জানাতে বললেন। তখন তেজবতী প্রার্থনা করলেন যে, তিনি যেন তার গৃহে অবস্থান করেন, যাতে সে সূর্যদেবের তেজরশ্মি দ্বারা আতপচাল তৈরি করতে পারে।
তখন সূর্যদেব বললেন, যদি সে সূর্যদেবকে পতিরূপে গ্রহণ করে তবেই তিনি তার গৃহে অবস্থান করবেন। প্রথমে তেজবতী এই কথা শুনে অবাক হলেও উপায়ান্তর না দেখে রাজি হলেন।
এবার কথা মত সূর্যদেব তেজবতীর গৃহে অবস্থান করলেন এবং তেজবতী আতপচাল তৈরি করলেন। সূর্যদেব পরদিন প্রভাতে বিছানা ত্যাগ করার পূর্বে তার তেজকিরণের অংশ দ্বারা পুঁইশাক সৃষ্টি করলেন। এবং তার গৃহ ত্যাগ করলেন। তেজবতী রাজার কাছে আতপ চাল পৌঁছে দিয়ে এসে দেখলেন যে বিছানার উপর একটি পুঁইশাক রয়েছে।
পরদিন ছিল দ্বাদশী। সেদিন পুঁইশাক ভক্ষণ করলেন সেই বিধবা ব্রাহ্মণী। আর এই ভক্ষণের ফলশ্রুতিতে তেজবতী গর্ভবতী হয়ে পড়লেন। 
অচিরেই এই খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজা এই সংবাদ শুনে তেজবতীকে সুশ্চরিত্রা ভেবে বন্দী করলেন। 
রাত্রিতে স্বপ্নাদেশে রাজা দেখলেন যে, হংসবাহনে চড়ে জটাধারী এক দিব্যপুরুষ তাকে বলছেন যে, “ হে রাজন তুমি ভুল করছ। তুমি ভুল করছ তেজবতীকে দুশ্চরিত্রা ভেবে বন্দী করে। এ এক দিব্যলীলা। কাল প্রভাতে তুমি তাকে মুক্ত করে দেবে।“ এই বলে সেই দিব্যপুরুষ অন্তর্ধান হলেন।
পরদিন রাত ভোর হতে না হতেই তেজবতীকে মুক্ত করলেন রাজা।

এর কিছুদিন পর তেজবতী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। সেই সন্তান তেজস্বী, চতুর্বাহু বিশিষ্ট, কানে কুন্ডল এবং মাথায় জটা। তার নাম রাখা হল জীমূতবাহন। 
সময় যায়। জীমূতবাহন বড় হতে থাকে। একদিন পাঠশালায় সকলে তার পিতার নাম জিজ্ঞাসা করে। জীমূতবাহন ফিরে এসে মায়ের কাছে পিতৃপরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন সূর্যদেব তার পিতা। পিতার সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য যে পথে সূর্যদেব উদয়গিরি যান সেই পথে তিনি তার পুত্রকে নিয়ে গেলেন। 

সূর্যদেব যখন সেই পথে রথে করে যাচ্ছেন সেই সময় জীমূতবাহন সূর্যদেবের রথের দড়ি ধরে টান দিলেন। সূর্যদেব তার পরিচয় জানতে চাইলে তেজবতী বললেন যে জীমূতবাহন তার সন্তান। 

কিন্তু সূর্যদেব সব অস্বীকার করলেন। তেজবতী তখন তাকে পূর্বের সব কথা বললেন। সাক্ষী হিসাবে চিল আর শিয়ালীর কথা বললেন। তারাও সমস্ত কথা সূর্যকে জানাল। তাতেও সূর্যদেব মানতে না চাইলে তেজবতী সূর্যকে অভিশাপ দিতে উদ্যত হলেন। এইসময় সূর্য সমস্ত কিছু স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। জীমূতবাহনকে নিজের সন্তানের স্বীকৃতি দিয়ে বললেন, “দেবতাদের মত তার এই পুত্রেরও মর্ত্যলোকে পূজা হবে, সকল মর্ত্যবাসী বিশেষ করে নারীরা সন্তান লাভ এবং সন্তানের দীর্ঘায়ু কামনায় আশ্বিন মাসে কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে সন্ধ্যের পর এই ব্রত পালন করবে। পূজা শেষে রাত্রি জাগরন ও পরদিন পারন পালন করবে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়ে নিজেরা খাবেন।

জিতাষ্টমীর আরো একটি ব্রতকথা আছে। সেটি হল - 

কোন এক দেশে শালিবাহন নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন খুব নিষ্ঠাবান ও ধার্মিক। তাঁর বিপুল ঐশ্বর্য থাকলেও ছিল না কোন সন্তান। এই কারণে রাজা আর রানীর মনে সুখ, শান্তি ছিল না। রাজা বহুবার বহু যজ্ঞ করালেন ছেলেমেয়ে হওয়ার জন্যে, কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। কত তাবিজ, কবজ ধারণ করলেন। কিন্তু নাহ ফল কিছুই হল না। দুঃখে ম্রিয়মান রানী একদিন রাতে এক স্বপ্ন দেখলেন, এক দেবতা হাঁসে চড়ে এসে বলছেন, “রানী তুমি জিতাষ্টমীর ব্রত কর। তোমার ছেলেমেয়ে হবে।“ 
পরদিন সকালে রাজাকে রানী সব জানাতে তিনি শুধু মতই দিলেন না সমস্ত আয়োজনও করতে থাকলেন।
ক্রমে এল আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি। রাজার আদেশ মত উঠোনে একটি ছোট পুকুর কাটিয়ে তাতে কলাগাছ আর বেল গাছ পুঁতে দিলেন। রানীও ব্রতের প্রথা অনুযায়ী সারাদিন উপোষ থেকে সন্ধ্যের সময় মটর ও ফলের নৈবিদ্য দিয়ে জীমূতবাহনের পুজো করলেন ও নিজে প্রসাদ খেয়ে বাকিদেরও প্রসাদ দিলেন। পরেরদিন সকালে উঠে রানী চান করে আবার সেই পুকুরের কাছে গিয়ে নিয়মিত পুজো করলেন সন্তান কামনায়। 

এর কিছুদিন পর রাজা আর রানীর এক ছেলে আর এক মেয়ে হল। শালিবাহন ছেলের নাম রাখলেন জীমূতবাহন আর মেয়ের নাম সুশীলা। 

দিন যায়। জীমূতবাহন বিবাহযোগ্য হলে এক সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়ে গেল। বউটি ভালো হল বটে কিন্তু একটি বিষয়ে দুঃখ রয়ে গেল। জীমূতবাহন আর রাজকন্যের কয়েকটি ছেলেমেয়ে হল কিন্তু তারা অকালেই মারা গেল।

এদিকে শাশুড়ি কিন্তু উঠোনে পুকুর কাটিয়ে নিয়মমত জিতাষ্টমীর ব্রত পালন করতে থাকেন। কিন্তু বউটি এসব দেখে শুধু হাসে আর উপহাস করে শাশুড়িকে। এই উপহাসই যে তার সন্তানের মৃত্যুর কারণ সে বুঝতেও পারে না।
এই ভাবে সময় যেতে যেতে আবার এল আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী। শাশুড়ি এবার অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুজিয়ে বউকে রাজি করালো ব্রত করাতে। প্রথমে হাসি আর উপোষ করতে পারবে না বললেও শেষে সে রাজি হল ব্রত করতে। ব্রত শেষে সে সন্তান কামনা করল।
কিছুদিন পর সে গর্ভবতী হল। নির্দিষ্ট সময়ে তার এক ছেলে হল। এরপর তার সমস্ত ছেলেমেয়ে বেঁচে থাকল এই ব্রতের কারনে

                                 - - -