মকর সংক্রান্তি
পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে বলা হয় মকর সংক্রান্তি। এই দিনে সূর্য্য মকর রাশিতে প্রবেশ করে। হিন্দু জ্যোতিষ শাস্ত্র অনুযায়ী 'সংক্রান্তি' একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়ে থাকে। ১২টি রাশি অনুযায়ী এ রকম সর্বমোট ১২টি সংক্রান্তি রয়েছে। সূর্যাদির এক রাশি হতে অন্য রাশিতে সঞ্চার বা গমন করাকেও সংক্রান্তি বলা যায়। সংক্রান্তি শব্দটি বিশ্লেষণ করলেও একই অর্থ পাওয়া যায়; সং+ক্রান্তি, সং অর্থ সঙ সাজা এবং ক্রান্তি অর্থ সংক্রমণ। অর্থাৎ ভিন্ন রূপে সেজে অন্যত্র সংক্রমিত হওয়া বা নুতন সাজে, নুতন রূপে অন্যত্র সঞ্চার হওয়া বা গমন করাকে বুঝায়। বাস্তবেও তা-ই দেখা যায়। মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীন এই বারটি একটির পর আরেকটি চক্রাকারে অবর্তিত হতে থাকে। রাশিচক্রস্থ দৃশ্যমান গমন পথ যাকে ইংরেজীতে ঊপষরঢ়ঃরপ বা ক্লান্তিবৃত্ত বলে; সেপথে সূর্য গমনের ফলে (জ্যোতিষতত্ত্বমতে) পৃথিবীর পরিমণ্ডলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপ ধারণ করে। এভাবে পৃথিবী নানারূপে সঞ্চারের কারণে প্রাকৃতিক দৃশ্যপট প্রতিমাসে পরিবর্তিত হতে থাকে। পৃথিবীর পরিমণ্ডলে এধরনের পরিবর্তনের মধ্যে সনাতন ধর্মের অনুসারীগণের মধ্যে চারটি দিন উল্লেখযোগ্য। তন্মমধ্যে দুই অয়ন এবং দুই বিষুব দিন। দুই অয়ন হল উত্তরায়ন ও দক্ষিণায়ন এবং বিষুব হল মহাবিষুব ও জলবিষুব। চৈত্র সংক্রান্তিতে মহাবিষুব ও আশ্বিন সংক্রান্তিতে জলবিষুব আরম্ভ হয়। উল্লেখ্য বছরে যে দুইদিন দিবা ও রাত্রি সমান হয় তাকে বিষুব দিন বলা হয়। বসন্তকালে যে বিষুব হয়, তাকে মহাবিষুব আর শরৎকালে যে বিষুব হয় তাকে জলবিষুব বলা হয়। মৎস্যপুরাণেও তাই বলা হয়েছে-
“মৃগকর্কটসংক্রান্তিঃ দ্বে তূদগ্দক্ষিণায়নে।
বিষুবতী তুলামেষে গোলমধ্যে তথাপরাঃ ॥”
অর্থাৎ সুর্য ধনুরাশি ত্যাগ করে মকর রাশিতে সঞ্চার হওয়াকে উত্তরায়ণসংক্রান্তি, মিথুনরাশি হতে কর্কটরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি, কন্যারাশি হতে তুলারাশিতে সঞ্চার হওয়াকে জলবিষুবসংক্রান্তি আর মীনরাশি হতে মেষরাশিতে সঞ্চার হওয়াকে মহাবিষুব সংক্রান্তি বলা হয়ে থাকে।গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মকর সংক্রান্তি ১৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়। তবে কখনও কখনও ১৩ বা ১৫ জানুয়ারিও মকর সংক্রান্তি পড়ে।জ্যোর্তিবিজ্ঞান বলেছে দক্ষিণায়নের সময় দক্ষিণ গোলার্ধে সূর্যরশ্মি বেশি থাকে ফলে সেখানে দিন বড় রাত ছোট আর উত্তরায়ণে উত্তর গোলার্ধে দিন বড় রাত ছোট হয়। আর সূর্যের আলোর উষ্ণতাই তো প্রাণীকুলের বিকাশের অন্যতম কারণ। ঠিক এই কথা অনুযায়ী মকর সংক্রান্তির দিন থেকেই শুরু হয় উত্তরায়ণ। আর পুণ্যতীর্থ ভারতবর্ষের অবস্থানও তো উত্তর গোলার্ধে। এই দিন থেকেই উত্তর গোলার্ধে দিন বড় হতে শুরু কর। তাই এই মকর সংক্রান্তির দিনটিকে প্রাধান্য দিয়ে পালন করা হয়ে থাকে এখানে।
দিনটির বিশেষত্ব :-
১।। এই দিনে দেবতাদের দিন শুরু হয়। দেবতারা ঘুম হতে জাগন।
২।। এই দিনে কুরু-পিতামহ ভীষ্ম দেহত্যাগ করেন।
৩।। এই দিনে ভগবান সূর্য্যেদেব মকর রাশিতে গিয়ে পুত্র শনিদেবের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
৪।। এই দিনে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ঘূড়ি ওড়ান ।
৫।। এই দিনে মৃত্যু হলে বিষ্ণুলোক প্রাপ্তি হয়।
৬।। মকর সংক্রান্তি নতুন ফসলের উৎসব। তবে এ
৭।। মকরসংক্রান্তি 'উত্তরায়ণের সূচনা' ও একে অশুভ সময়ের শেষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
অঞ্চলভেদে মকর সংক্রান্তি :-
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে এই উৎসব আয়োজনের চল আছে। তবে দেশ ভেদে এই উৎসবকে নানা নামে ডাকা হয়। নেপালে এই দিনটি 'মাঘে সংক্রান্তি' নামে সুপরিচিত। আবার থাইল্যান্ডে এর নাম 'সংক্রান' এবং কম্বোডিয়ায় এর নাম 'মহাসংক্রান' । ‘সংক্রান্তি’ নামটির সঙ্গে এর মিল কিন্তু লক্ষণীয়। মায়ানমারে 'থিংগিয়ান' এবং লাওসে এই উৎসবের নাম 'পি মা লাও' । এ ছাড়াও পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে এবং ভারত মহাসাগরীয় বহু দ্বীপে যেখানে ভারত থেকে বহু মানুষ অভিবাসী হয়ে গিয়েছিলেন, সেখানেই পালিত হয় মকর উৎসব।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও মকর সংক্রান্তি বিভিন্ন নামে পরিচিত। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে লোহ্রি, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ ও 'ইল্লু বিল্লা' , কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত। উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, ওডিশা, মহারাষ্ট্রে 'তিলগুল' , গোয়া, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি নামটিই চলে, যদিও তার পাশাপাশি স্থানীয় নামেরও প্রচলন আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশে সুকরাত বা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় খিচড়ি পর্ব।
পালনীয় রীতি :-
পুণ্যস্নান এই উৎসবের একটা প্রধান অঙ্গ। পুণ্যার্থীরা সমুদ্রে, গঙ্গায় বা অন্য কোনও নদীতে স্নান করে পুণ্য অর্জন করেন। গঙ্গাসাগর, জয়দেব কেন্দুলি, দ্বারবাসিনী প্রভৃতি স্হানে এই উপলক্ষ্যে পূন্যস্নান ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই উত্তরায়ণ দেবত্বের- আলোর দিক অর্থাৎ সাকারাত্মকের প্রতীক। এই জন্যই এই দিনটিতে জপ, তাপ, দান, স্নান, শ্রাদ্ধ, তর্পন, ধর্মীয় কার্যাদি করা হয়ে থাকে। কারণ এই দিনটির মহত্বই আলাদা। ধারনা আছে এই দিনে দান করলে তার নাকি শতগুনে ফিরে প্রাপ্তি হয়। অবাঙালিদের মতে মকর সংক্রান্তির দিন যদি ঘি ও কম্বল দান করা যায় তাহলে মোক্ষ লাভ হয়। মনে করা হয় মকর রাশিতে সূর্যের প্রবেশ অত্যন্ত ফলদায়ক। তাইতো এই দিন স্নান করে তিল দান করার রীতি আছে বাঙালিদের মধ্যে।
নতুন ফসল ওঠার সুচনায় যে হেতু এই উৎসব পালিত হয়, সে হেতু ভারতের অনেক জায়গায় এই উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে বহু পরিবারে নতুন পোশাক পরার চল আছে। সব মিলিয়ে কৃষি ভিত্তিক সমাজের অন্যত
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন