মঙ্গলবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮

নব পত্রিকা




কলা, কচু ,হলুদ ,জয়ন্তী ,মান ,বেল,ডালিম ,অশোক ,ধান - -  এই নয়টি গাছকে একত্রে বলা হয় নবপত্রিকা।  দুর্গাপূজাতে এই নবপত্রিকা  একটি অপরিহার্য্য অংশ   । 
শাস্ত্রে বলা হয়েছে 
"……… রম্ভা ,কাচ্চ, হরিদ্রা , জয়ন্তী , বিল্বদাড়িমৌ ।
অশোকা, মানকশ্বৈব, ধানাঞ্চ, নবপত্রিকা ।।"
 


অর্থাৎ কলা, কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, অশোক, মান ও ধান এরা নবপত্রিকা । এই সকল বৃক্ষের মধ্যে মাতৃ শক্তির অবস্থান চিন্তা করা হয় ।
রম্ভাধিষ্ঠাত্রী ব্রহ্মাণী, কচ্বাধিষ্ঠাত্রী কালিকা, হরিদ্রাধিষ্ঠাত্রী উমা, জয়ন্ত্যাধিষ্ঠাত্রী কার্তিকী, বিল্বাধিষ্ঠাত্রী শিবা,
দাড়িম্বাধিষ্ঠাত্রী রক্তদন্তিকা, অশোকাধিষ্ঠাত্রী শোকরহিতা, মানাধিষ্ঠাত্রী চামুণ্ডা ও ধান্যাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মী
কলার অধিষ্ঠাত্রি ব্রাহ্মনী, কচুর কালীকা, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তীর কার্ত্তিকী, বেলের শিবা, ডালিমের রক্তদন্তিকা, অশোকের দেবী শোকরহিতা (চামুন্ডা) , ধানের লক্ষ্মী ।
      এই  বৃক্ষগুলি আমাদের প্রয়োজনীয় ও  বিশেষ গুণসম্পন্ন   যা আমাদের মানব দেহের জন্যেও উপকারি। 
কলাঃ
এটি আমাদের একটি পরিচিত ফল। কলার বৈজ্ঞানিক নাম Musa Paradisiaca L. কলার ব্যাপক পুষ্টি গুণের জন্যে একে ফ্রুট অব ওয়ায়িজ বা জ্ঞানের ফল বলা হয়। কলাতে প্রায় সকল প্রকার ভিটামিন অর্থাৎ এ, বি, সি, ডি এবং ম্যাগনেশিয়াম, পটাসিয়াম, সুক্রোজ, ফ্রুকটোজ ও গ্লুকোজ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে যেগুলো মানব দেহের জন্যে প্রচুর দরকারি ।
কচুঃ
কচুর বৈজ্ঞানিক নাম Colocasia Esculenta(L) Schott . কচু শাঁকে রয়েছে প্রচুর ভিটামিন এ। এছাড়া রয়েছে প্রোটিন, শর্করা, স্নেহ, ভিটামিন বি-১(থায়ামিন) বি-২(রিবোফ্লাবিন) সি ক্যালসিয়াম , লৌহ ইত্যাদি গুরুত্ত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান ।
হরিদ্রাঃ
হলুদ কে সংস্কৃতে হরিদ্রা বলা হয়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Curcuma Longa L. এটি সাধারণত মশলা এবং রূপ চর্চাতে ব্যাবহৃত হয় । হলুদে প্রচুর পরিমাণ প্রোটিন, খনিজ লবণ, ফসফরাস, ক্যালসিয়াম, লোহা ইত্যাদি আছে। তাছাড়া হলুদ ক্যান্সার প্রতিরোধি এবং মানব দেহে টিউমারের বৃদ্ধি রোধ করে ।
জয়ন্তীঃ
এই গাছটির সংস্কৃত নাম জয়ন্তীকা ও বিজ্ঞানসম্মত নাম Sesbania sesban ।
গাছটি জমির নাইট্রোজেন আবদ্ধিকরনে সাহায্য করে জমি উর্বর করে ।
বেলঃ
সংস্কৃতে বেলকে  শ্রীফল বলা হয়। বেলের বৈজ্ঞানিক নাম Aegle marmelos correa । বেল গাছ শিব ঠাকুরের প্রিয়। বেলে রয়েছে শর্করা, ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ক্যারোটিন, স্নেহ, থায়ামিন,রিবোফ্লাবিন, নায়াসিন, অ্যাসকোরিক আ্যাসিড, টার্টারিক আ্যাসিড, ইত্যাদি উপাদান । বেল কোষ্ঠ্যকাঠিন্য সমস্যায় খুব কার্যকর । এ ছাড়া অজীর্ন, পেটের গোলমাল ইত্যাদিতে খুবই উপকারি ।
দাড়িম্ব (ডালিম)ঃ এটি আমাদের পরিচিত ফল । বৈজ্ঞানিক নাম Punica granatum Linn । আমরা সবাই জানি রোগীদের পথ্য হিসাবে এটি বহুল ব্যাবহৃত। এটি রক্ত বর্ধক এবং মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে ।
অশোকঃ
এটি মাঝারি আকারের চির সবুজ গাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম Saraca indica । এই গাছ ভেষজ গুণ সম্পন্ন । আন্ত্রিক রোগ, উদারাময়, ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসায় এটি ব্যাবহৃত হয় ।
মানঃ
এটিও আমাদের পরিচিত । বৈজ্ঞানিক নাম Alocasia indica (Roxb)Schott । এটি রক্ত দুষ্টিনাশক।অশ্বরোগে উপকারি, সেই সাথে কোষ্ঠবদ্ধ রোগে কার্যকর । বাত ব্যাথা নিরাময়ে এটি ফলপ্রদ ।
ধানঃ
ধানের বৈজ্ঞানিক নাম Oryza sativaOryza glaberrima ।ধান Graminae/Poaceae গোত্রের উদ্ভিদ।  ধানের কথা বিস্তারিত নাই বা বলি, কারণ এ সম্পর্কে সবাই আমরা কম বেশি জানি ।
মহাসপ্তমীর দিন সকালে নিকটস্থ নদী বা কোনও জলাশয়ে  নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তাঁর পিছন পিছন ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান।  স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরিয়ে দেবীর ডান দিকে  স্থাপন করা হয়। নবপত্রিকা প্রবেশের পূর্বে পত্রিকার সম্মুখে দেবী চামুণ্ডার আবাহন ও পুজো করা হয়। পত্রিকাস্থ অপর কোনো দেবীকে পৃথকভাবে পুজো করা হয় না। নবপত্রিকা প্রবেশের পর দর্পণে দেবীকে স্নান করানো হয়। এরপর বাকি দিনগুলিতে নবপত্রিকা অন্যান্য দেবদেবীদের সঙ্গেই পূজিত হন। 
অনেকে বলেন নবপত্রিকা নাকি গণেশের বউ । যা কি না একটি ভ্রান্তিমূলক কথা । পৌরানিক কাহিনীতে আমরা গণেশের স্ত্রীর নাম পাই ঋদ্ধি এবং সিদ্ধি । আসলে নবপত্রিকা কে ঘোমটা দিয়ে নতুন বধূর মত করে সাজানো হয়, যার ফলে অনেক জায়গায় নবপত্রিকা কে কলাবৌ নামে ডাকা হয় এবং দুর্গা পূজার চালচিত্রে তার অবস্থান হল মাতৃভক্ত গণেশের পাশে । সম্ভবত এই কারণে সমাজে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে ।উপরের বর্ণনায় আমরা স্পষ্টই দেখেছি নবপত্রিকা অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা যেমন ধানে লক্ষী, হলুদে দুর্গা এরা সবাই মায়ের অংশ , তাই নবপত্রিকা গণেশের মা, তথা প্রকৃতি স্বরূপিণী মা দুর্গা । নিঃসন্দেহে আমাদের এই মহাপাপজনক ভ্রান্ত ধারণা থেকে উত্তোরন প্রয়োজন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন