মৃতের দোষ ও তার খন্ডন :
এ জগতে সবকিছুই অনিশ্চিত। যা নিশ্চিত তা হল কর্মফল। কর্মফল হতে রেহাই নেই। এ জগতের পাপ এ জগতে ও পরজগতে ভোগ করতে হবে। নশ্বর এই পঞ্চভৌতিক দেহ এ জন্মের ও গতজন্মের প্রারব্ধ ভোগ করে। বাকিটুকু ভোগ করে যাতনাদেহ ও পরজন্মের পঞ্চভৌতিক দেহ। আর এই প্রারব্ধের জন্যই মৃত্যু হয় বিশেষ বিশেষ শুভ বা অশুভ মূহুর্তে। অশুভ মূহুর্তে মৃত্যু হলে মৃত্যুদোষ হয় ও যাতনাদেহ প্রেতত্ব প্রাপ্ত হয়।
মৃতের এই দোষ ও পুষ্কর-ত্রিপুষ্কর দোষ নিয়ে গরুড় পুরাণে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে ভগবান নারায়ণ বলেছেন আর প্রশ্ন করেছেন তার বাহন গরুড়।
মহাভারত বলে -
বিধাতৃবিহিতং মার্গং ন কশ্চিদতিবর্ততে ।
কালমূল মিদং সর্বং ভাবাভাবৌ সুখাসুখম্ ।।
কালঃ সৃজতি ভূতানি কালঃ সংহরতে প্রজাঃ।।
সংহরন্তং প্রজাকালং কালঃ শময়তে পুনঃ।।
কালো হি কুরুতে ভবান্ সর্বান্ লোকে শুভাশুভান্ ।
কালঃ সংক্ষিপতে সর্বাঃ প্রজাঃ বিসৃজতে পুনঃ ।।
কালঃ সুপ্তেষু জাগর্তি কালো হি দুরতিক্রমঃ ।
কালঃ সর্বেষু ভুতেষু চরত্যবিধৃতঃ সমঃ।।
(মহাভারত আদিপর্ব /শ্লোক ২০৮-২১১)
অর্থাৎ, বিধাতার নিদিষ্ট পথকে কারোরই অতিক্রম করার সাধ্য নেই। তে পারে না, ভাব-অভাব, সুখ-দুঃখ সবই কালের নিয়ন্ত্রণে। কালই শুভাশুভ নির্ণয় করে ও জীবের সৃজন-সংহার করে । কাল সবসময়ই জাগ্রত থাকে আর সে দুরতিক্রম্য। সে সর্সবভুতে বিচরণ করে।
অর্থাৎ, সবকিছুর মূলেই এই কাল বা সময়। তাই কালই সমস্ত প্রারব্ধের মূল। এই কালকে অতিক্রম না করা গেলেও বোঝার চেষ্টা করেছেন ঋষিরা। তারা কালের শুভাশুভের ভিত্তিতে মৃতের দোষ নির্ধারণ করেছেন। যা বিভিন্ন পুরাণ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে উল্লেখিত হয়েছে।
এ বিষয়ে গ্রহযামল তন্ত্রের চতুর্থ পটলে বলা হয়েছে -
"পূনর্বসুত্তরাষাঢ়া কৃত্তিকাশ্চফাল্গুনি।
পূর্ব্বভদ্রং বিশাখা চ রবিভৌমশনৈশ্চরঃ।।
দ্বীতিয়া সপ্তমীশ্চৈব দ্বাদশীতিথিরেব চ।
এত্তেবামেকদং যোগে ভবতীতি ত্রিপুষ্কর।।
জাতে তুঃ জারজো যোগং মৃতে ভবতি পুষ্করঃ।।
[জ্যোতিষ তত্ত্বঃ,বারাহসংহিতা]
অর্থাৎ -
নক্ষত্র দোষ : পুনর্বসু, উত্তর আষাঢ়া, কৃত্তিকা, ফাল্গুনী, পূর্বভাদ্রপদ ও বিশাখা নক্ষত্রে মারা গেলে মৃতের দ্বিপাদ দোষ হয়। মান =২ ।
বারদোষ : শনি, মঙ্গল এবং রবিবারে মৃত্যু হলে মৃতের একপাদ দোষ হয়। মান =১ ।
তিথি দোষ : দ্বিতীয়া, সপ্তমী এবং দ্বাদশী তিথিতে মৃত্যু হলে মৃতের একপাদ দোষ হয়। মান = ১ ।
এখন মৃতের দোষ নির্ণয় করতে হলে নিচের সূত্রটি অনুসরণ করতে হবে।
মোট দোষ = নক্ষত্র দোষ + বার দোষ + তিথি দোষ
এখন নক্ষত্র, বার বা তিথি কোনোটাই উপরোক্ত সূচির মধ্যে না পড়লে মোট দোষ = ০+০+০ অর্থাৎ শূন্য হবে। নক্ষত্র, বার, তিথির মধ্যে যদি এক বা একাধিক উপরোক্ত সূচিতে পড়ে তবে তাদের জন্য নির্দিষ্ট মান বসবে।
আর তিনটিই যদি উপরোক্ত সূচিতে পড়ে তবে মোট দোষ =২+১+১ =৪ হবে। আর একেবারেই পুষ্কর বলে। এই যোগে মৃতে পুষ্কর দোষ আর জন্মে জারজ যোগ হয়।
আবার মৃতে নক্ষত্র দোষের সাথে সাথে বার বা তিথি যে কোনও একটি দোষ হয় তবে যোগফল তিন হয়। একে ত্রিপুষ্কর যোগ বলে।
আবার,
"বারাণাং প্রথমে ভাগে তিথিনাং চাদ্যমধ্যয়োঃ।
নক্ষত্রে প্রথমে পাদে ত্রিপুষ্কর ইতি স্মৃতঃ।।"
অর্থাৎ, বারের প্রথম ভাগে , তিথির আদি ও মধ্যভাগে এবং নক্ষত্রের প্রথম ভাগে মৃত্যু হলে ত্রিপুষ্কর হয়।
মৃত্যু দোষের ফলাফল :
মৃত্যুকালীন দোষ তার পরিবার আর বাস্তুর উপর কুপ্রভাব ফেলে। অনেক সময় ওই পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনও এই কুপ্রভাব থেকে অব্যাহতি পায় না। এই বিষয়ে বরাহ সংহিতার স্পষ্ট উক্তি -
"ধমাসাভান্ত্যরে তস্য সুতহানিং বিনিশ্চিতঃ।
অথবা স্বামিনাং হন্তি দ্বীতিয়ং ভ্রাতরস্তথা।।
তৃতীয়ং সর্ব্বহানিং স্যাৎ সুতবিত্তবিনাশনম্।"
[শব্দকল্পোদ্রুমোক্ত বরাহ সংহিতা] অর্থাৎ, নক্ষত্র দোষে গোত্র নাশ হয়। বার দোষে শস্য ও পুত্র নাশ হয়। এবং তিথি দোষে গো ধন নাশ হয়।
আবার ত্রিপুষ্কর দোষের ফলাফল সম্পর্কে বরাহসংহিতায় বলা হয়েছে -
"সুতো ভ্রাতা তথা জায়া পতিঃ শ্বশুর এব চ্
মাতা পিতা স্বসা বাপি পিতৃব্যো ভগিনী।"
অর্থাৎ, ত্রিপুষ্কর দোষে মাতা পিতা ভগিনী পিতৃব্য ভগিনীপতি পুত্র ভ্রাতা স্ত্রী স্বামী শ্বশুর সকলেই নানা বিষয়ে অবশ্য পীড়িত হবে।
এ বিষয়ে বলতে গিয়ে গ্রহযামল তন্ত্র আবার আরেককাঠি এগিয়ে গিয়েছে। এখানে চতুর্থ পটলে শিব-পার্বতী সংবাদে স্বয়ং ভগবান শিব বলছেন -
"নক্ষত্রে গোত্রহানিঃ স্যাদ বাস্তু বৃক্ষ ন জীবিতঃ।।
যার সরল অর্থ হল, পুষ্কর দোষে বাস্তু বৃক্ষ পর্যন্ত জীবিত থাকেনা। ষোলো মাসের মধ্যে পুষ্কর দোষের কারণে গৃহকর্ত্তার সর্ব্বনাশ হয়।অর্থ-সম্পদ,পুত্র এমনকি নিজ জীবন ও বিনাশ হতে পারে। তাহলে ভাবতেই পারছেন যে পুষ্কর দোষ কি ভয়ানক বালাই।
পুষ্কর দোষ খণ্ডনের উপায় -
দোষ থাকলে তা খণ্ডনের উপায়ও আছে । সুতরাং পুষ্কর দোষ কাটানোর উপায়ও আছে। আমাদের শাস্ত্রে সেগুলি বিশদভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে উপায়গুলো সঠিক ব্রাহ্মণ ডেকে করাতে হবে। নাহলে উপায়ের কোনও ফল হবে না।
এ সম্পর্কে গ্রহযামল তন্ত্রের পঞ্চম পটলে শিব-পার্বতী সংবাদে বলা হয়েছে -
"পুষ্করোধ্বরকে দেবি হোতা ব্রাহ্মা চ পুস্তকী।
সদস্যো গ্রহভূদেবহন্যথা স্যাদ বিফলা ক্রিয়া।
পুষ্করোরিষ্ট শমনে পূজাদ্রব্যবরাননে।
গ্রহদ্বিজ সমাহূয়া পূজয়িত্বা নিবেদয়েৎ।।
গ্রহদ্বিজাদ্ বিভিন্নায় পুষ্করা দ্রব্যাকার্পনে।
ন নস্যেৎ তস্য তদ্রিষ্টং পুনরেব প্রবর্ততে।।"
যার অর্থ, ভগবান শিব মাতা পার্বতীকে বলেন,
হে দেবী !পুষ্কর যজ্ঞে হোতা,ব্রহ্মা ও পুস্তক ধারী সদস্য ইহারা গ্রহদ্বিজ বা আচার্য্য ব্রাহ্মণ হলে কাজ সিদ্ধ হয়, অন্যথায় কাজ বিফল হয়।
পুষ্কর দোষ পেলেই শান্তি করাতে হবে। নাহলে পরিবারের সদস্যদের দেবতারাও রক্ষা করতে পারবেন না।
তাই পুষ্কর শান্তি করাতে হবে গ্রহবিপ্র ডেকে এবং শাস্ত্রীয় বিধি মেনে। এজন্য সাধারণত হোম করতে হয় বা সোনা দান করতে হয়। এই দান বা হোম মৃত ব্যক্তির অশৌচ কালের মধ্যেই করতে হবে।
এবিষয়ে শুদ্ধিকারিকার মত হল -
“মুখ্যকালে স্তিদং সৰ্ব্ং সুতকং পরিকীর্তিতম্। আপাদগতস্য সৰ্ব্বস্য সুতকোঽপি ন সুতকম্॥"
তবে এই সমস্ত কাজ এই শ্মশানেই করা উচিত ।অভাবে উঠোনে, দরজায় করা যায়, যা সঠিক ফল দেয় না।
এছাড়াও একপাদ দোষ হলে অষ্টোত্তর মাত্র তুলসীপত্র দ্বারা শ্রীবিষ্ণুর পূজা, শিবপুজা, বিষ্ণুর সহস্রনামের একাবৃত্তি পাঠ, ১০৮ দূর্গানাম ও মধূসূদন, শ্রী বিষ্ণুর সহস্রনাম একাবৃত্তি পাঠ বিধেয়।
দ্বিপাদ দোষ হলে অষ্টোত্তর শত তুলসীপত্র দ্বারা শ্রীবিষ্ণুপূজা, সহস্র দূর্গানাম ও মধূসূদন নাম জপ, চারবার শিবপূজা , দেবীমাহাত্ম্যপাঠ একরূপ, যথাশক্তি কাঞ্চানদান।
ত্রিপাদ দোষ হলে অষ্টোত্তরসহস্রসংখ্যক তুলসীপত্রদ্বারা শ্রীবিষ্ণুর পূজা, দশসহস্র দূর্গানাম, শ্রী মধূসূদন নাম জপ, দ্বাদশ শিবপূজা , তিনের অধিকবার চন্ডীপাঠ , কাঞ্চনদান, শ্রী বিষ্ণুহোম ১০৮ ষোড়শোপচারে শ্রী বিষ্ণু পূজা আবশ্যক।
ত্রিপুষ্করদোষ হলে অষ্টোত্তরসহস্রসংখ্যক তুলসীপত্রদ্বারা শ্রীবিষ্ণুর পূজা, দশসহস্র দূর্গানাম, শ্রী মধূসূদন নাম জপ, দ্বাদশ শিবপূজা , তিনের অধিকবার চন্ডীপাঠ , নবগ্রহ হোম , সভোজ্য কাঞ্চনদান , শ্রী বিষ্ণুহোম ১০৮ ষোড়শোপচারে শ্রী বিষ্ণু পূজা আবশ্যক ।
তবে এই কাজে সঠিক গ্রহবিপ্র প্রয়োজন। সঠিক ছন্দ ও উচ্চারণের সঙ্গে মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারে এমন গ্রহবিপ্রই পুষ্কর শান্তির জন্য উপযুক্ত। এই কাজ এতটাই সাবধানতার সাথে করতে হয় যে সামান্য ভুলের জন্য ব্রাহ্মণ ও কর্তার বিপদ উপস্থিত হয়। ও কাজ নিষ্ফল হয়।
তবে এ বিষয়ে একটা কথা জানা আবশ্যক যে সব পুষ্কর দোষ ক্ষতিকর হয়না। এজন্য পুষ্করের নির্ণয় দরকার। পুষ্কর যদি স্বর্গে অবস্থান করে তবে তা ক্ষতিকর নয় এবং শান্তি আবশ্যক হয় না। অপরদিকে পুষ্কর পাতালে অবস্থান পাতালে করলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়। কিন্তু পুষ্কর যদি মর্ত্যে অবস্থান করে তবে তা খুবই ক্ষতিকারক এবং দ্রুত শান্তি আবশ্যক ।