সরস্বতী মহাভাগে
( মূল পাতা ) : ছবি- রাজা রবি বর্মা
সময় বড় বেগবান, সে স্থির থাকতে চায় না মোটেই। আর যত সময় এগিয়ে চলে ততই মানুষের দক্ষতাগত বিকাশের সাথে সাথে বৌদ্ধিক বিকাশ আসতে থাকে কমে। এ যেন ভাষার বিকৃতি। একটা শব্দ ধীরে ধীরে তৎসম তদ্ভবের মাধ্যমে হারায় তার আসল উচ্চারণ ও অর্থ। ঠিক তেমনি শাস্ত্র আর ধারনাতে লাগে লৌকিক গালগল্পের ধুলো।
দীর্ঘদিন ধরেই একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় বারম্বার, যে বিদ্যার দেবী মা সরস্বতী কে ? সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা কি তার স্বামী না পিতা ? ব্রহ্মা কি নিজ কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন ?
প্রথমেই বলি, এইসব আজগুবি প্রশ্নের আবির্ভাব ঘটেছে পুরাণের মতো কিছু গ্রন্থের প্রক্ষেপন আর হিন্দুধর্মের প্রতি বিদ্বেষযুক্ত কিছু নরাধমের কারনে। আসুন এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর খুঁজি।
আমাদের সবার আগে জানতে হবে সরস্বতী কে, আর ব্রহ্মাই বা কে। ব্রহ্মা হলেন হিন্দু ত্রিদেবের অন্যতম। আর এই ত্রিদেব হলেন নির্গুণ নিরাকার ব্রহ্মের স্বগুণ সাকার রূপ। সুতরাং ব্রহ্মা কোনও মানব বা দেবতা নন যে তার উপর মানবিক বা দৈবিক গুণ বা নিয়ম আরোপিত হবে।
এবার আসি তার সৃষ্টির কথায়। ব্রহ্মা তার প্রতি কল্পের সৃষ্টিতে সবকিছু সৃজন করেন এবং পরার্ধকল্পে সৃষ্টি ধ্বংস করে ঘুমোতে যান। এক কল্পে একাত্তর মন্বন্তর ও এক মন্বন্তরে একহাজার মহাযুগ। মোট ৪৩,২০,০০০ বছরে এক মহাযুগ।
আর ব্রহ্মার সৃষ্টির জন্য স্ত্রীর প্রয়োজন হয় না। তার ইচ্ছামাত্রেই সৃষ্টি হয়। তার দশ হাজার মানসপুত্র ইচ্ছামাত্রেই সৃষ্টি হয়েছে। যারা এই কল্পের আদি পুরুষ।
ঠিক এই কারণেই ব্রহ্মার মূর্তি প্রচলিত নয়। কারন স্রষ্টাকে নিরাকার দেখানোর রীতি প্রাচীন। তিনি সর্বময়।
এবার আসি দেবী সরস্বতীর কথায়।
দেবী সরস্বতী হলেন আদিদেবী। আদিশক্তি। কেনোও নারী নন। আমাদের হিন্দু দর্শন মতে সৃষ্টির মূল তত্ত্ব দুটি। প্রকৃতি ও পুরুষ। প্রকৃতি আর পুরুষের মাঝে মায়ারূপ আঁঠাই জগতকে ভৌতিক রূপ দান করেছে। ক্ষিতী, অপ, তেজ, মরূৎ ও ব্যোম হল এই প্রকৃতি-পুরুষের সম্মিলিত রূপ। আর প্রকৃতি অর্থাৎ শক্তিকে আমরা নারীরূপে কল্পনা করি। তাই দেবী সরস্বতীর নারীরূপ।
পরবর্তিতে এই দেবী সরস্বতী হতেই অন্যান্য দেবীর উৎপত্তি। পুস্পাঞ্জলি মন্ত্রেও তাই দেবীকে ভদ্রকালী বলা হয়েছে।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
মা কালীর গলায় পঞ্চাশটি নরমুণ্ড আসলে পঞ্চাশটি বর্ণের প্রতীক। মা তো বাগেশ্বরী। তাই ঋকমন্ত্রে মাকে বাক রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে তান্ত্রিক দেবী তারা তো আসলে নীলসরস্বতী। নিরুক্তকার যাস্ক আবার দেবী সরস্বতীকে নদী বলে উল্লেখ করেছেন। যা সরস্বতী সভ্যতার ভিত্তি। ‘তত্র সরস্বতী ইতি এতস্য নদীবদ্বেতাবচ্চ নিগমা ভবন্তি।’ স্কন্দপুরাণের প্রভাসখণ্ডেও যাস্কের মতের সমর্থন দেখা যায়। আবার মোহদুষ্ট শুম্ভকে অদ্বৈত জ্ঞান দান করেছিলেন। 'একৈবাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়াকা মমাপরা'।
দেবী সরস্বতী কিন্তু আবার যে সে নদী নন। দেহের মধ্যে প্রবহমান গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতীর অন্যতমা। অর্থাৎ তিনিই জ্ঞানরূপিনী সুমুম্না।
একজন প্রশ্ন তুলেছেন পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্রে 'কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে' শব্দবন্ধ নিয়ে। মহাকবি কালীদাসের এই সরস্বতী স্তবের ভুল কপিপেষ্ট হয়েছে এখানে। কুচ নয় শব্দটি কুর্চ হবে। কুর্চ মানে মধ্যমা ও অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগের স্পর্শস্থল। সরস্বতীর ছবি লক্ষ্য করুন ঠিক মধ্যমা ও অঙ্গুষ্ঠের স্পর্শস্থলেই মুক্তোর হার আছে। জপমালা।
সুতরাং এটা পরিস্কার যে স্রষ্টা সত্ত্বার নারীরূপই হলেন দেবী সরস্বতী । তিনি না কারোর স্ত্রী না কারোর কন্যা।
আবার প্রাচীন কালে রাজাকে বলা হত প্রজাপতি আর সভা ও সমিতিকে তার কন্যা বলা হত। অর্থাৎ রূপক। তাই কোথাও কন্যা বা স্ত্রী বলা হলেও তা রূপকার্থে হতে পারে। ( ঋগ্বেদ ১০/৬১/৭)
শতপথ ব্রাহ্মণে দেবী সরস্বতীকে বাক বাণী ( 7/5/1/31), জিহ্বা ( 7/9/1/14), বাণী রশ্মি পৃথিবী ইন্দ্রিয় (2/5/1/11) বলা হয়েছে। তাই আবার প্রমাণিত যে দেবী সরস্বতী কারোর কন্যা বা স্ত্রী নন।
দেবী সরস্বতীর সাথে ব্রহ্মা ও মনুর যৌনতা নিয়ে গল্প ফেঁদেছেন এক দেববিদ্বেষী। তিনি জানেনই না যে একমাত্র ব্রহ্মচারীরই অধিকার সরস্বতী মন্দিরে প্রবেশ করার। সুতরাং এসব গালগল্পের কোনও মান্যতা নেই। হ্যাঁ, কিছু নকল পুরাণে প্রক্ষিপ্ত শ্লোক দিয়ে এসব প্রমাণ করার চেষ্টাও হয়েছে যার কোনও অথেনটিকেশন নেই। মনে রাখবেন পুরাণে বহুবার উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রক্ষেপন হয়েছে। তাই কিছু বলার আগে রেফারেন্স সহ দেবেন যেটা অনুসন্ধান করে বোঝা যাবে যে আপনি ঠিক না ভুল পথে চলেছেন।
তবে রূপকার্থে ধরলে দেহস্থ সুমুম্না রূপিনী সরস্বতী মিলিত হয়েছেন ব্রহ্মরূপ সহস্রার সঙ্গে। আর যোগী তার ব্রহ্মবস্তুকে সুমুম্না সরস্বতী পথে সহস্রায় স্থাপন করলেই এই জন্ম জন্মান্তরের চক্র হতে মুক্তি ঘটে। তাই স্ত্রী বলা অন্যায় নয়। অপরদিকে সহস্রার হতেই সুমুম্না সরস্বতীর শুরু বলে কন্যা রূপকও অর্থহীন নয়।
লক্ষ কোটি বছরেরও আগে-
ছিল যবে সব নিরাকার, মহাশূন্য মহাঅন্তহীন,
সেথা কোন বৈষম্যের বশে পলকেরও ভগ্নাংশ সময়ে
ভীষণ প্রণবনাদে হল বিস্ফোরণ।
সেই সে প্রণব হল তোমার প্রথম প্রকাশ,
আদিপরাশক্তি শব্দব্রহ্ম বাগ-বাগীশ্বরী।
তোমার বীণার সুরে সৃষ্টি হয় গ্রহ নিহারিকা,
তোমার বীণার সুরে সুপারনোভা ঘটে বারবার,
জন্ম-মৃত্যু-জীবনের সুরের লহরী।
গায়ত্রীর চব্বিশ চরণে প্রাতঃ-সন্ধ্যা-মধ্যাহ্নে তোমার গমন,
সবিতা তুমি প্রসবিছ জগৎ সংসার।
হে বরদে ! তোমারর কুর্চমূলে যে মুকুতা হার
সে হারে জপিছ সদা সময়ের কাষ্ঠা-দন্ড-পল,
গণিছ সৃষ্টি-স্থিতি ভীষণ সংহার।
কি সাধ্য আমার দেবী গাহি তব মহিমা অপার,
জগৎসার মাঝে ধূলিকণা আমি।
নিন্দুকের কিবা সাধ্য ধরে তব দোষ,
সমুদ্রের জলকণা সমুদ্রেরে করি পরিহাস
নিজেরেই পরিহাসে জানি।
শ্রী তুমি, তুমি বাণী, তুমি মাগো গুণের আকর,
শ্বেতকমলের পরে মরালবাহিনী,
তব নাম মুখরিত হোক সামগানে,
ঋকমন্ত্রে ঘোষিত হোক তোমার কাহিনী।
সবশেষে বলি মা সরস্বতী জ্ঞানের দেবী । তার আশীর্বাদের আলোকে মনের মলিনতা দূর হয়ে যাক।