(মূল পাতা )
"শ্যামা মা কি আমার কালো রে ,
কালো রুপে দিগম্বরী,
হৃদিপদ্ম করে মোর আলোরে ।"
কমলাকান্তের এই বহুল শ্রুত পদটি শুনেই মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন জাগে, কালী কি সত্যিই কালো ? যিনি জগৎপ্রসবিনী তার এই অসিতরুপ কেন ?
যদি আমরা তন্ত্রের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, মহানির্বানতন্ত্রের চতুর্থ উল্লাসের ২৫ তম শ্লোকে বলা হয়েছে "সৃষ্টেরাদৌ ত্বমেকাসীৎ তমোরুপম্ অগোচরম্ ।" অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে দেবী একাকিন তামসীরুপে অদৃশ্য ভাবে বিরাজিতা ছিলেন ।
বিজ্ঞান বলে বর্ণমণ্ডলের সাতটা রং একসাথে মিলিয়ে দিলে কালো রংয়ে পরিণত হয়। অর্থাৎ সকল রং, সকল বর্ণ, সকল সৃষ্টি যেখানে একসাথে মিশেছে সেই সত্তাই হলো কালী। এজন্যই এই তমোময়ী আদিমূর্তির রং কালো । জগতের সব রং মিশেছে এই গাত্রবর্ণে ।
তবে কোনও কোনও সাধক ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন । ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ বলেছেন, কালী কি আমার কালো ? দুরে তাই কালো । জানতে পারলে কালো নয়।আকাশের নীল বর্ণ ,দুর থেকে কাছে গিয়ে দেখো, কোন রং নেই।
এবার আসি কালীর করালবদনা মূর্তির প্রসঙ্গে
কালীমূর্তিতেমরা দেখি যে দেবী তার দাঁত দিয়ে জিভ চেপে রেখেছেন। মুখের দু পাশ দিয়ে রুধিরধারা গড়িয়ে পড়ছে। এখানে জিভ লোভের প্রতীক, আর দাঁত সংযমের। লোভাদি রিপুকে সংযমের দশন দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখাটাই এই রুপের ব্যাখ্যা।
অপরদিকে কালী সংহারকর্ত্রী ।
“কলয়তি ভক্ষয়তি সর্বমেতদত্র প্রলয়কালে ইতি কালী”- অর্থাৎ প্রলয়কালে যিনি জগৎপ্রপঞ্চকে ভক্ষষ করেন তিনিই কালী। প্রলয়কালে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড তার করালবদনে লয়প্রাপ্ত হয়।সবকিছু গ্রাস করেন তিনি । তাই রক্তধারা তার ওষ্ঠের দু'পাশ দিয়ে ঝড়ে পড়েছে।
দেবীর ত্রিনয়ণা
আমরা যদি শ্রী শ্রী চণ্ডী দেখি তবে তাতে পাই,
' প্রলয়ানল ধূম্রাভে চন্দ্রসূর্য্যাগ্নি লোচনে।'
অর্থাৎ দেবীর তিনটি নেত্র চন্দ্র সূর্য ও অগ্নিস্বরূপ।আবার অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যৎ বা স্বর্গ,মর্ত্য,পাতালও বলতে পারেন। রামপ্রসাদের গানেও আছে, মায়ের আছে তিনটি নয়ণ ,চন্দ্র,সূর্য্য আর হুতাশন ।
দেবীর গলায় মুণ্ডমালা :
দেবী কালীকার গলায় পঞ্চাশটি সদ্যছিন্ন মুণ্ডের মালা। যেগুলো হতে রক্তের স্রোত ঝরে পড়ছে। এই সদ্যছিন্ন মুণ্ডগুলির এক একটি এক একটি বর্ণের প্রতীক। অ কার থেকে ক্ষ কার পর্যন্ত ৫০ টি বর্ণের প্রতীক এই পঞ্চাশটি মুণ্ড । কালী পঞ্চশৎ বর্ণময়ী। এই বর্ণমালাই সর্বশাস্ত্রের একক ,শব্দসৃষ্টির মূল। দেবী সর্ববিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী বলে ওই মূল বর্ণগুলিকে কন্ঠমালায় ধারণ করেছেন।
আর এখানে বর্ণের প্রতীক হিসাবে সদ্যছিন্ন নরমুন্ড কেন ? কারণ মুণ্ডই মানুষের দেহের প্রধান অংশ যা মানুষকে মানুষ করে। এখানেই থাকে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি । তাইতো দেবী মুণ্ডমালিনী।
শবরূপী শিব মায়ের পায়ের তলায় :
'মুন্ডমালিনীং দিব্যা সতত অট্টহাস্যকারীনিম, শবরুপি মহাদেব হৃদয়পরি সংস্থিতাম।'
মহাদেব শবরুপে দেবীর পদতলে বিরাজ করছেন। কিন্তু কেন ? কারণ শিব নিষ্ক্রিয় পুরুষ আর কালী হলেন সক্রিয় প্রকৃতি । তাই তিনি শবরুপী শিব, মা আদিপ্রকৃতির অধীনস্থ । নিষ্ক্রিয়তার উপরে ক্রিয়াশীলতার আধিপত্য। সাংখ্য অনুসারে পুরুষ সাক্ষিস্বরুপ আর প্রকৃতি ক্রিয়াময়ী। তাই শক্তির পদতলে শিব । শঙ্করাচার্য্যও বলেছেন, শক্তিযুক্ত না হলে শিবেরও স্পন্দন ক্ষমতা নেই । তাই দেবীর পায়ের তলায় নিশ্চল হয়ে পড়ে রয়েছেন শিব । তন্ত্রমতে , শক্তির দুটি অবস্থা, নিষ্ক্রিয় ও ক্রিয়াশীল। শক্তি যখন নিষ্ক্রিয় তখন সে শিব ।আর যখন ক্রিয়াশীল ওজাগ্রত তখন সে কালী। তাই কালী ও শিব দুই নিত্যরুপে এই মূর্তিতে প্রকাশিত ।
প্রকৃতপক্ষে শবরুপ শিবের উপর দন্ডায়মান কালী। দক্ষিণা কালীর মূর্তিতে দেবী শিবের উপর বিপরীতরতাতুরা বা রতিক্রিয়ার বিপরীত ভঙ্গিতে উপবিষ্টা ।
অপরদিকে ভক্তকবি সাধককবি রামপ্রসাদ বলেছেন অন্য তত্ত্ব। তিনি বলেছেন -
'দৈত্যবেটা ভূমে পড়ে,
মা দাড়িয়ে তার উপরে,
মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ শিবরুপ হয় রনস্থলে।'
অর্থাৎ মায়ের পাদস্পর্শে দৈত্য অর্থাৎ অশিব শিবে রূপান্তরিত হয়েছে।
মায়ের কানে শিশুশবের কর্ণাভরণ :
তন্ত্র অনুনারে দেবীর দুই কানে দুটি শিশুর শব হল তার কর্ণাভরণ। বালকবৎ সরল নির্বিকার তত্ত্বজ্ঞ সাধকই দেবীর প্রিয়। তারই প্রতীক স্বরুপ ওই দুটি শিশুর শরীর তিনি কানের অলঙ্কার হিসাবে গ্রহন করেছেন ।
খড়্গ :
দেবীর বাম দিকের উপরের হাতে খড়্গ। এটি জ্ঞানের প্রতীক। জ্ঞানখড়্গের আঘাতে সাধকের সবরকম বন্ধন মুক্ত করেন কালী। নিষ্কাম সাধকের মোহপাশ তিনি জ্ঞানের অস্ত্র দিয়ে ছিন্ন করেন।
ছিন্ন মুণ্ড :
দেবীর বাঁদিকের নিচের হাতে রয়েছে ছিন্ন মুণ্ড । ছিন্নমুণ্ডটি তত্ত্বজ্ঞানের আধার। নিষ্কাম সাধকের মোহপাশ থেকে তাকে মুক্ত করেছেন দেবী উপরের হাতেরধরা খড়্গ দিয়ে। আর তত্ত্বজ্ঞানের আধারটিকে ধরে রেখেছেন নিচের হাতে। মুক্তি সম্ভবায়িত করেছেন যিনি, তিনিই মুক্ত জ্ঞানীকে আশ্রয় দিয়েছেন অভয়হস্তে।
অভয়মুদ্রা :
ডানদিকের উপরের হাতে অভয় মুদ্রা আর নিচের হাতে বরদানের মুদ্রা দুটি হাতে মা সন্তানকে অভয় প্রদান করছেন।
দিগম্বরী :
মা আমার দিগম্বরী। কারন তিনি সর্বব্যাপিনী, ভূমাস্বরুপিনী। সামান্য বস্ত্রখন্ড দিয়ে তাকে আবৃত করা যায় না । দশদিক তার আভরণ। দিক অম্বর তার। সর্ববন্ধনহারিনী মায়ের যোগ্যবস্ত্র অমিল বলেই তিনি উলঙ্গিনী । অসীম অম্বর সম্বরিত নারে, তাইতে নাম ধরেছে দিগম্বরী।
নরকরমালা:
দেবীর কোমরে কাটা হাতের মালা। জীব দেহত্যাগের পর সূক্ষ্ম শরীরে কালীকার বিরাটরশরীরে অবস্থান করে। পুনর্জন্ম না হওয়া পর্যন্ত তার এই দশা বহাল থাকে । হাত জীবের ক্রিয়াশক্তির আধার।সেই হাত মা নিজের কোমরে জড়িয়ে নিয়েছেন । তার কটিদেশ তাই ন এছাড়াও আরও দুটি বিষয় এই মালায় নিহিত। প্রথমত, প্রলয়কালেজীবের সর্বকর্ম্ম কালস্বরুপা কালীতেই লীন হয়। আড়াল করেছেন তার যোনি । অর্থাৎ সৃষ্টির স্থান। সৃষ্টিস্থানের অবরণ পরবর্তী কল্প প্রকাশের বীজ আধার, ক্রিয়াশক্তির হাতে ।
কালীপুজোর উপযুক্ত সময় :
শাস্ত্রানুসারে,
'দিবাচার্দ্ধ প্রহরিকা চাদ্যন্তে পরমেশ্বরী।
ঋতু দণ্ডাত্নিকা সা চ রাত্রিরুক্তা মনীষিভিঃ।।
ততো বৈ দশ নাদ্যন্ত নিশা মহানিশা স্মৃতাঃ।
সর্বদা চ সমাখ্যাতা সর্ব সাধন কর্মনি।।'
অর্থাৎ, সূর্যাস্তের পর অর্দ্ধ প্রহর বা চার দণ্ড অর্থাৎ ছিয়ানব্বই মিনিট সময়কে বলা হয় দিবাকাল, এবং তার পরবর্তী ছয়দণ্ড বা ১৪৪ মিনিট সময়কালকে বলে রাত্রিকালে। কার্ত্তিকমাসে সুর্যাস্ত যাবার সময় মোটামুটিভাবে ৫:২৫ মি ধরে রাত্রিকালের সময় রাত ৯:২৫ মি পর্যন্ত। সূর্যাস্তের পর এই দশদন্ড সময় হলো দিবারাত্রকাল।
এই দিবারাত্রকালের সময় বাদ দিয়ে পরবর্তী দশদণ্ড (২৪০ মিনিট) বা চারঘন্টা সময়কে বলা হয় নিশা ও মহানিশা। তাহলে রাত ৯:২৫ মি থেকে গভীর রাত্রি ১:২৫ মি সময় হলো নিশা মহানিশা সময়কাল। যা সর্ব সাধন মার্গের পথে উৎকৃষ্ট সময় কাল। এই নিশা ও মহানিশা সময়কালই দেবী কালীকার পূজার সর্বোত্তমকাল। এই সময়ের মধ্যেই দেবীপূজা সম্পন্ন করার কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছে।
কালীপুজোর কিছু নিয়ম:-
তোড়লতন্ত্রে সদাশিব পার্বতীকে বলছেন, "হে পার্বতী, দেবী কালিকা, দেবী তারিণী ও ত্রিপুরসুন্দরীকে পঞ্চতত্ত্বসহকারে ষোড়শোপচারে পূজা করা উচিত।
পূজয়েদ্ কালিকাং দেবী তারিণীং বাথ সুন্দরীম্।
ষোড়শেন উপচারেণ পঞ্চতত্ত্বেণ পার্ব্বতী।।