ধর্মপুজো
ধর্মরাজ পুজো বা ধরম পুজা বুদ্ধপূর্ণীমার তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মঠাকুর সাধারণত গ্রামের শেষে একটা বটগাছের ( ক্ষেত্রবিশেষে অন্য কোন গাছের তলায় ) একটি সিঁদুর-মাখানো নির্দিষ্ট আকারবিহীন প্রস্তরখণ্ডে ধর্মঠাকুরের পূজা করা হয়। প্রধানত বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোম ইত্যাদি বর্ণের মানুষেরা ধর্মঠাকুরের পূজা করে থাকে।ধর্মঠাকুর বিভিন্ন চর্মরোগ বিশেষ করে কুষ্ঠব্যাধি নিরাময় করেন, ভক্তকে সন্তানের বরদান করেন বলে মনে করা হয়।
আকার :-
ধর্মঠাকুর হলেন নিরঞ্জন অর্থাৎ শূন্যতার প্রতীক । সূর্যের মতো তিনিও সাদা এবং তার বাহন ঘোড়ায় টানা রথ বা ঘোড়া । এজন্য রাঢ়বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মঠাকুরের পূজার সময় মাটির ঘোড়া দেওয়ার প্রথাও প্রচলিত আছে। ধর্মঠাকুরের বাহন সাদা ঘোড়া এবং সাদা ফুল তাঁর প্রিয়। তাঁর আসল প্রতীক পাদুকা বা খড়ম।
আসলে ধর্মঠাকুর হলেন বুদ্ধ, সূর্য, শিব এবং বিষ্ণুর মিলিত দেবতা । অধ্যাপক শ্রীসুকুমার সেন ধর্মঠাকুর কে মিশ্রিত দেবতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ” ডিসকভারী অফ লিভিং বুদ্ধিজম অফ বেংগল” নিবন্ধে ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ দেবতা আখ্যায়িত করেছেন। “তারকেশ্বরের শিবতত্ত্ব” পুঁথিতে আছেঃ
” বহু দেব বহু মঠ না হয় কথন।
নীচ জাতি গৃহে দেখ ধর্ম সনাতন
বৌদ্ধধর্ম বৌদ্ধ চর্চা করিতে নির্মুল।
এতাদৃশ অনুষ্ঠান করে সাধুকুল “
অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম নির্মূল করে তার স্থলে ধর্মঠাকুরের উদ্ভব হয়।
ধর্মঠাকুরের মূর্তি বা প্রতীক বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে–যেমন
১। ঘট, শিলা, মুণ্ডমূর্তী, পোড়ামাটির ঘোড়া, ঘটপ্রতীক
২। রাজবেশধারী মূর্তি।
৩। পৌরাণিক দেবতার অনুরুপ
৪। মহাদেবের অনুরূপ (জটা ও ত্রিশুল ছাড়া )
৫। সাধারণ শিলাখন্ড প্রতীক যা ধর্মশীলা নামে পরিচিত
৬। ধ্যানী বুদ্ধের মতো।
পুজা :-
বহু জায়গায় ধর্মঠাকুরের নিত্যপুজা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত তিন প্রকারে অনুষ্ঠিত হয়: নিত্য, বারমতি এবং বাৎসরিক। এই নিত্যপুজা সাধারণত অনারম্বড় হয়।
বুদ্ধপূর্ণীমার দিন পূজায় পাঁঠা, হাঁস ও পায়রা এমনকি শূকর বলি দেওয়ার রীতি আছে।
পূজায় যারা ব্রতধারন করে বেত হাতে সন্নাসীবেশ ধারন করে তাদের ভক্ত বলে। ভক্তরা প্রচুর পরিমানে মাদক সেবন করে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর নৃত্য করে ও সারা শরীরে বানবিদ্ধ করে। ধর্মঠাকুরের পূজায় কোন জাতিভেদ নেই তাই বহুস্থানে তাঁর পূজায় হাঁড়ি, ডোম, বাগ্দী প্রভৃতি জাতির লোক পৌরহিত্য করে । তবে বর্তমানে ধীরে ধীরে সেই স্থান ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা দখল করছেন। পূজার সময় অনেক ভক্তের ভর হয়। মনে করা হয় যে ধর্মঠাকুর তার শরীরে অবস্থান করে আদেশ দান করেন। পূজা শেষে পুরোহিত বিগ্রহের উপর ফুল রাখেন, ঢাক ঢোল বেজে উঠে, বিগ্রহ থেকে ফুল সহজে পড়ে গেলে মঙ্গল মনে করা হয়। একে ফুলপড়া বলে।
অনেকে অভীষ্ট কামনায় মন্দিরের গাছে ঢিল ও মাটির ঘোড়া ঝুলিয়ে দেন। এই পূজায় পদ্ম ফুলের বিশেষ প্রয়োজন হয়।
ধর্মমঙ্গল:-
ধর্মঠাকুরের পূজার প্রাধান্য কাল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। এই সময়কালে বহু ধর্মমঙ্গলের কবিদের রচনা পাওয়া গিয়েছে, মুদ্রিতও হয়েছে। মনে করা হয় রামাই পন্ডিত ছিলেন ধর্মঠাকুরের এর প্রথম পুরোহিত ও প্রচারক । রামাই পন্ডিতের 'শূণ্যপুরাণ' ধর্মমঙ্গলের আদিরুপ। রামাই পন্ডিতের কাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। তিনি আনুমানিক ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে হতে ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিদ্যমান ছিলেন।
কিন্তু ধর্মমঙ্গল ধারার প্রথম কবি হলেন ময়ূরভট্ট। তাঁর রচিত 'হাকন্দপূরান' বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল । এরপর আসে পরবর্তী কবি খেলারাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল। এছাড়াও শ্যাম পণ্ডিত, ধর্মদাস , সীতারাম দাস, রামদাস আদক, মাণিকরাম গাঙ্গুলি ও যদুনাথ পণ্ডিত উল্লেখযোগ্য।