শুক্রবার, ১৭ মে, ২০১৯

Dharmapuja

ধর্মপুজো
                                       
                            ধর্মরাজ পুজো বা ধরম পুজা বুদ্ধপূর্ণীমার তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়।  ধর্মঠাকুর সাধারণত গ্রামের শেষে একটা বটগাছের ( ক্ষেত্রবিশেষে অন্য কোন গাছের তলায় ) একটি সিঁদুর-মাখানো নির্দিষ্ট আকারবিহীন প্রস্তরখণ্ডে ধর্মঠাকুরের পূজা করা হয়। প্রধানত বাউড়ি, বাগদি, হাড়ি, ডোম ইত্যাদি বর্ণের মানুষেরা ধর্মঠাকুরের পূজা করে থাকে।ধর্মঠাকুর বিভিন্ন চর্মরোগ বিশেষ করে কুষ্ঠব্যাধি নিরাময় করেন, ভক্তকে সন্তানের বরদান করেন বলে মনে করা হয়।
আকার :-
ধর্মঠাকুর হলেন  নিরঞ্জন অর্থাৎ শূন্যতার প্রতীক ।  সূর্যের  মতো তিনিও সাদা এবং তার বাহন ঘোড়ায় টানা রথ বা ঘোড়া । এজন্য রাঢ়বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মঠাকুরের পূজার সময় মাটির ঘোড়া  দেওয়ার প্রথাও প্রচলিত আছে। ধর্মঠাকুরের বাহন সাদা ঘোড়া এবং সাদা ফুল তাঁর প্রিয়। তাঁর আসল প্রতীক পাদুকা বা খড়ম।
আসলে  ধর্মঠাকুর  হলেন  বুদ্ধ, সূর্য, শিব এবং বিষ্ণুর মিলিত দেবতা । অধ্যাপক শ্রীসুকুমার সেন ধর্মঠাকুর কে মিশ্রিত দেবতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ” ডিসকভারী অফ লিভিং বুদ্ধিজম অফ বেংগল” নিবন্ধে ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধ দেবতা আখ্যায়িত করেছেন।  “তারকেশ্বরের শিবতত্ত্ব”  পুঁথিতে আছেঃ

” বহু দেব বহু মঠ না হয় কথন।
 নীচ জাতি গৃহে দেখ ধর্ম সনাতন
বৌদ্ধধর্ম বৌদ্ধ চর্চা করিতে নির্মুল।
এতাদৃশ অনুষ্ঠান করে সাধুকুল “
অর্থাৎ বৌদ্ধধর্ম নির্মূল করে তার স্থলে ধর্মঠাকুরের উদ্ভব হয়।
ধর্মঠাকুরের মূর্তি বা প্রতীক বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে–যেমন
১। ঘট,  শিলা, মুণ্ডমূর্তী, পোড়ামাটির ঘোড়া, ঘটপ্রতীক
২। রাজবেশধারী মূর্তি।
৩। পৌরাণিক দেবতার অনুরুপ
৪। মহাদেবের অনুরূপ (জটা ও ত্রিশুল ছাড়া )
৫। সাধারণ শিলাখন্ড প্রতীক যা ধর্মশীলা নামে পরিচিত
৬। ধ্যানী বুদ্ধের মতো।


পুজা :-
বহু জায়গায় ধর্মঠাকুরের নিত্যপুজা অনুষ্ঠিত হয়। সাধারণত তিন প্রকারে অনুষ্ঠিত হয়: নিত্য, বারমতি এবং বাৎসরিক। এই নিত্যপুজা সাধারণত অনারম্বড় হয়।
বুদ্ধপূর্ণীমার দিন   পূজায়  পাঁঠা, হাঁস ও পায়রা এমনকি শূকর বলি দেওয়ার রীতি আছে।
পূজায় যারা ব্রতধারন করে বেত হাতে সন্নাসীবেশ ধারন করে তাদের ভক্ত বলে। ভক্তরা  প্রচুর পরিমানে মাদক সেবন করে, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর নৃত্য করে ও সারা শরীরে বানবিদ্ধ করে। ধর্মঠাকুরের পূজায় কোন জাতিভেদ নেই তাই বহুস্থানে তাঁর পূজায়  হাঁড়ি, ডোম, বাগ্দী প্রভৃতি জাতির লোক পৌরহিত্য করে । তবে বর্তমানে ধীরে ধীরে সেই স্থান ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা দখল করছেন। পূজার সময় অনেক ভক্তের ভর হয়। মনে করা হয় যে ধর্মঠাকুর তার শরীরে অবস্থান করে আদেশ দান করেন। পূজা শেষে পুরোহিত বিগ্রহের উপর ফুল রাখেন, ঢাক ঢোল বেজে উঠে, বিগ্রহ থেকে ফুল সহজে পড়ে গেলে মঙ্গল মনে করা হয়। একে ফুলপড়া বলে।
অনেকে অভীষ্ট কামনায় মন্দিরের গাছে ঢিল ও মাটির ঘোড়া ঝুলিয়ে দেন। এই পূজায় পদ্ম ফুলের বিশেষ প্রয়োজন হয়।
ধর্মমঙ্গল:-
                                         ধর্মঠাকুরের পূজার প্রাধান্য কাল পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত। এই সময়কালে বহু ধর্মমঙ্গলের কবিদের রচনা পাওয়া গিয়েছে, মুদ্রিতও হয়েছে। মনে করা হয় রামাই পন্ডিত ছিলেন ধর্মঠাকুরের এর প্রথম পুরোহিত ও প্রচারক । রামাই পন্ডিতের 'শূণ্যপুরাণ' ধর্মমঙ্গলের আদিরুপ। রামাই পন্ডিতের কাল সম্পর্কে মতভেদ আছে। তিনি আনুমানিক  ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে  হতে  ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে বিদ্যমান ছিলেন।
কিন্তু ধর্মমঙ্গল ধারার  প্রথম কবি হলেন ময়ূরভট্ট। তাঁর রচিত 'হাকন্দপূরান' বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল । এরপর আসে পরবর্তী কবি খেলারাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল। এছাড়াও শ্যাম পণ্ডিত, ধর্মদাস , সীতারাম দাস, রামদাস আদক, মাণিকরাম গাঙ্গুলি ও যদুনাথ পণ্ডিত উল্লেখযোগ্য।

মঙ্গলবার, ৭ মে, ২০১৯

Akshay tritiya

                      অক্ষয় তৃতীয়া

অক্ষয় তৃতীয়া হল চান্দ্র বৈশাখ মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথি। অক্ষয় তৃতীয়া বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ তিথি। অক্ষয় শব্দের অর্থ হল যা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে এই পবিত্র তিথিতে কোন শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে।
যদি ভালো কাজ করা হয় তার জন্যে আমাদের লাভ হয় অক্ষয় পূণ্য। আর যদি খারাপ কাজ করা হয় তবে লাভ হয় অক্ষয় পাপ। তাই এদিন খুব সাবধানে প্রতিটি কাজ করা উচিত। খেয়াল রাখতে হয় ভুলেও যেন কোনো খারাপ কাজ না হয়ে যায়। কখনো যেন কটু কথা না বেরোয় মুখ থেকে। কোনো কারণে যেন কারো ক্ষতি না করে ফেলি বা কারো মনে আঘাত দিয়ে না ফেলি। তাই এদিন যথাসম্ভব মৌন জরুরী। আর এদিন পূজা,জপ,ধ্যান,দান,অপরের মনে আনন্দ দেয়ার মত কাজ করা উচিত। যেহেতু এই তৃতীয়ার সব কাজ অক্ষয় থাকে তাই প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলতে হয় সতর্কভাবে।
এবারের অক্ষয়তৃতীয়া সবার ভালো কাটুক – এই কামনায় করি।
এদিন যে,সকল তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল।
১) এদিনই বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার পরশুরাম জন্ম নেন পৃথিবীতে।
২) এদিনই রাজা ভগীরথ গঙ্গা দেবীকে মর্ত্যে নিয়ে এসেছিলেন।
৩) এদিনই গণপতি গনেশ বেদব্যাসের মুখনিঃসৃত বাণী শুনে মহাভারত রচনা শুরু করেন।
৪) এদিনই দেবী অন্নপূর্ণার আবির্ভাব ঘটে।
৫) এদিনই সত্যযুগ শেষ হয়ে ত্রেতাযুগের সূচনা হয়।
৬) এদিনই কুবেরের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে মহাদেব তাঁকে অতুল ঐশ্বর্য প্রদান করেন। এদিনই কুবেরের লক্ষ্মী লাভ হয়েছিল বলে এদিন বৈভব-লক্ষ্মীর পূজা করা হয়।
৭) এদিনই ভক্তরাজ সুদামা শ্রী কৃষ্ণের সাথে দ্বারকায় গিয়ে দেখা করেন এবং তাঁর থেকে সামান্য চালভাজা নিয়ে শ্রী কৃষ্ণ তাঁর সকল দুঃখ মোচন করেন।
৮) এদিনই দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ করতে যান এবং ভগবান তার সখীকে রক্ষা করেন শ্রীকৃষ্ণ।
শরনাগতের পরিত্রাতা রূপে এদিন শ্রী কৃষ্ণা দ্রৌপদীকে রক্ষা করেন।
৯) এদিন থেকেই পুরীধামে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে রথ নির্মাণ শুরু হয়।
১০) কেদার বদরী গঙ্গোত্রী যমুনত্রীর যে মন্দির ছয়মাস বন্ধ থাকে এইদিনেই তার দ্বার উদঘাটন হয়। দ্বার খুললেই দেখা যায় সেই অক্ষয়দীপ যা ছয়মাস আগে জ্বালিয়ে আসা হয়েছিল।
১১) এদিনই সত্যযুগের শেষ হয়ে প্রতি কল্পে ত্রেতা যুগ শুরু হয়।
অক্ষয় তৃতীয়া সম্পর্কে একটি পুরানিক গল্প দেয়া হল :
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির একবার মহামুনি শতানিককে অক্ষয় তৃতীয়া তিথির মাহাত্ম্য কীর্তন করতে বললেন ।
শতানিক বললেন পুরাকালে খুব ক্রোধসর্বস্ব , নিষ্ঠুর এক ব্রাহ্মণ ছিলেন । ধর্মকর্মে তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল,না । একদিন এক দরিদ্র ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণ তার নিকট অন্ন এবং জল ভিক্ষা চাইলেন । রণচন্ডী হয়ে ব্রাহ্মণ কর্কশ স্বরে তাঁর দুয়ার থেকে ভিখারীকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন আর বললেন যে অন্যত্র ভিক্ষার চেষ্টা করতে ।
ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ভিখারী চলে যেতে উদ্যত হল ।
ব্রাহ্মণ পত্নী সুশীলা অতিথির অবমাননা দেখতে না পেরে দ্রুত স্বামীর নিকট উপস্থিত হয়ে ভরদুপুরে অতিথি সত্কার না হলে সংসারের অমঙ্গল হবে এবং গৃহের ধন সমৃদ্ধি লোপ পাবে … একথা জানালেন ।
স্বামীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভিখারীকে তিনি ডাক দিলেন এবং ভিখারীর অন্যত্র যাবার প্রয়োজন নেই সে কথা জানালেন । সুশীলা ত্রস্তপদে তার জন্য অন্নজল আনবার ব্যবস্থা করলেন । কিছুপরেই তিনি অতিথি ভিক্ষুকের সামনে সুশীতল জল এবং অন্ন-ব্যঞ্জন নিয়ে হাজির হলেন । ভিখারী বামুন অতীব সন্তুষ্ট হলেন এবং সে যাত্রায় সুশীলাকে আশীর্বাদ করে সেই অন্নজল দানকে অক্ষয় দান বলে অভিহিত করে চলে গেলেন ।
বহুবছর পর সেই উগ্রচন্ড ব্রাহ্মণের অন্তিমকাল উপস্থিত হল । যমদূতেরা এসে তার শিয়রে হাজির । ব্রাহ্মণের দেহপিঞ্জর ছেড়ে তার প্রাণবায়ু বের হ’ল বলে । তার শেষের সেই ভয়ঙ্কর সময় উপস্থিত । ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় তার কন্ঠ ও তালু শুকিয়ে গেল । তার ওপর যমদূতেদের কঠোর অত্যাচার । ব্রাহ্মণ তাদের কাছে দুফোঁটা জল চাইল এবং তাকে সে যাত্রায় উদ্ধার করতে বলল ।
যমদূতেরা তখন একহাত নিল ব্রাহ্মণের ওপর ।
তারা বলল ” মনে নেই ? তুমি তোমার গৃহ থেকে অতিথি ভিখারীকে নির্জ্জলা বিদেয় করেছিলে ?”
বলতে বলতে তারা ব্রাহ্মণকে টানতে টানতে ধর্মরাজের কাছে নিয়ে গেল ।
ধর্মরাজ ব্রাহ্মণের দিকে তাকিয়ে বললেন ” এঁকে কেন আমার কাছে এনেছ্? ইনি মহা পুণ্যবান ব্যক্তি ।বৈশাখমাসের শুক্লা তৃতীয়া তিথিতে এনার পত্নী তৃষ্ণার্ত অতিথিকে অন্নজল দান করেছেন । এই দানঅক্ষয় দান ।
সেই পুণ্যে ইনি পুণ্যাত্মা । আর সেই পুণ্যফলে এনার নরক গমন হবেনা । ব্রাহ্মণকে তোমরা জল দাও । শীঘ্রই ইনি স্বর্গে গমন করবেন !👏