বুধবার, ৬ জুন, ২০১৮

Raja Voja & stories


রাজা ভোজ ও অন্যান্য গল্প - - , , , 
মহাকবি কালিদাসের খ্যাতি দেখে অন্য কবিরা তাকে হিংসা করতেন  । একবার শতঞ্জয় বলে এক কবি কালিদাসকে নীচুদেখাবার জন্য রাজা ভোজের কাছে একটি স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শোনান ।
অপশব্দং শতং মাঘে ভৈরবী চ শতত্রয়ং
কালিদাসে ন গণয়ন্তে কবিরেকো শতঞ্জয়ঃ
অর্থাৎ----
মাঘ কবির রচনায় ১০০ ভূল আছে,  ভৈরবীর রচনায় ভূল আছে ৩০০টি, আর কালিদাসের রচনায় ভূল তো অসংখ্য।
মহাকবি কালিদাস এই কবিতার একটি শব্দের একটি মাত্রা পরিবর্তন করে কবিতাটির অর্থ বদলে দেন।
কালিদাস দ্বারা সংশোধনের পর - -
আপশব্দং শতং মাঘে ভৈরবী চ শতত্রয়ং
কালিদাসে ন গণয়ন্তে কবিরেকো শতঞ্জয়ঃ
অর্থাৎ - - -
মাঘ কবি জলের ১০০টি পর্যায়বাচী শব্দ জানেন, ভৈরবী জানেন ৩০০টি, আর কালিদাস জলের পর্যায়বাচী শব্দ জানেন অগণিত । দুর্ভাগ্যবশত কবি শতঞ্জয় জলের একটিই পর্যায়বাচী শব্দ জানেন  ।



ব্রাহ্মণ, স্বর্ণকার ও মহাকবি কালিদাস 
Brahman goldsmith and Mahakavi Kaalidas
রাজা ভোজ খুবই ন্যায়প্রিয় রাজা ছিলেন । তার রাজ্যে জটিল হতে জটিলতর অপরাধেরও ন্যায় বিচার হত ।
অপরাধী যতই না চতুরতার সাথে সাক্ষ্য প্রমাণ মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুক রাজার ন্যায় বিচার হতে বাঁচত না  ।
তার রাজ্যের দুই গ্রাম্য প্রজা অর্থ উপার্জন করতে শহরে গেল  । দুইজনের মধ্যে একজন ছিল ব্রাহ্মণ ও অপরজন স্বর্ণকার  । দুজনেই বিদেশে পরিশ্রম করে প্রচুর ধন উপার্জন করল  । ব্রাহ্মণ পন্ডিতগিরি করে প্রচুর রোজগার করলেন  । স্বর্ণকারেরও সোনা চাঁদির ব্যবসা খুব চলল  । কিন্তু ব্রাহ্মণের উপার্জন স্বর্ণকারের উপার্জন অপেক্ষা অনেক বেশি হল । স্বর্ণকার ব্রাহ্মণের উপার্জন বেশি দেখে হিংসায় জ্বলতে লাগল ।  কিন্তু ধূর্ত স্বর্ণকার নিজের ঈর্ষার কথা ব্রাহ্মণকে বুঝতে দিত না ।
বহু দিন পরে দুজনে একসাথে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন ।  পথের অনেকটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ।  আগের দিনে পথভ্রমন খুবই কষ্টকর ছিল ।  রাস্তা অনেক জঙ্গল ও বিহড়ে পরিপূর্ণ ছিল । রাস্তায় বন্য পশুর হাত হতে বাঁচতে যাত্রীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পথ চলত । পথে হিংস্র পশুর হাত হতে সুরক্ষার জন্য স্বর্ণকার একটা তলোয়ার নিল ও দুজনে রওনা দিল ।
ব্রাহ্মণ ও স্বর্ণকার দুজনের কাছেই স্বর্ণমুদ্রা ছিল ।  তাই দুজনেই যথাসম্ভব সাবধান হয়ে পথ চলছিল । ব্রাহ্মণের কাছে স্বর্ণকারের চেয়ে বেশি ধন ছিল ।  ব্রাহ্মণের পুঁটলি স্বর্ণকারের পুঁটলি অপেক্ষা ভারি ছিল । স্বর্ণকারের ব্রাহ্মণের ধনে লোভ জন্মাল । সে ব্রাহ্মণকে হত্যা করে সব ধন নিতে চাইছিল । সুযোগ পেয়ে স্বর্ণকার ব্রাহ্মণকে আক্রমণ করে বসল ।
ব্রাহ্মণ বুদ্ধিকরে স্বর্ণকারকে অনুনয়-বিনয় করলেন ।  বললেন - - "তুমি আমাকে মারো কিন্তু এই মন্ত্র আমার ঘরে পৌঁছে দিও ।
ব্রাহ্মণ একটি কাগজে চারটি অক্ষর "অ প্র শি খ " লিখে স্বর্ণকারকে দিল । স্বর্ণকার ঐ লেখাটি তার কোন সমস্যা করতে পারবে না ভেবে নিয়ে নিল । সে তখন ব্রাহ্মণকে হত্যা করে সব ধন নিয়ে নিজ ঘরে চলে গেল । এরপর স্বর্ণকার কুম্ভীরাশ্রু ফেলতে ফেলতে ব্রাহ্মণের বাড়ি গিয়ে সেই লেখাটি দিয়ে এল । ব্রাহ্মণপত্নীকে স্বর্ণকার বলল - - - "আমরা দুজন বাড়ি ফিরছিলাম, ব্রাহ্মণকে বাঘে ধরল ও মেরে খেয়ে নিল ।  কোনো রকমে আমি বেঁচে ফিরেছি ।"
 ব্রাহ্মণ পরিবার শোকে ভেঙ্গে পড়ল । কারোরই ঐ চিঠিতে লেখা চার অক্ষরের অর্থ বোধগম্য হচ্ছিল না । শোকাকুল ব্রাহ্মণ পরিবার রাজা ভোজের দরবারে আবেদন করল । রাজা ভোজ সভার সকল বিদ্বানকে চার অক্ষরের রহস্যটি সমাধান করতে বললেন । কিন্তু কেউই সফল হল না ।
শেষে এই সমস্যা সমাধানে মহাকবি কালিদাসকে ডাকা হল । কালিদাস তো আশুকবি ছিলেন, তাই তিনি শব্দগুলো ব্যবহার করে শীঘ্রই কাব্য রচনা করে দিলেন । যে কাব্য রচনা হল তা হতে বিরাট অপরাধের রহস্য সমাধান হল ।
অ তে -> অনেন স্বর্ণকারেণ
প্র তে -> প্রদেশে নির্জনে বনে
শি তে -> শিখামাদায় হস্তেন
 খ তে -> খড়্গেন নিহতঃ শিরঃ

অনেন স্বর্ণকারেণ, প্রদেশে নির্জনে বনে ।
শিখামাদায় হস্তেন,খড়্গেন নিহতঃ শিরঃ ।।
অর্থাৎ এই স্বর্ণকার রাজ্যের নির্জন এক বনে ব্রাহ্মণের শিখা ধরে খড়্গ দিয়ে শিরশ্ছেদ করেছে ।

রবিবার, ৩ জুন, ২০১৮

Raja Voja & poet Kalidas

রাজা ভোজ ও মহাকবি কালিদাস 

রাজা ভোজ ও অন্যান্য গল্প - - , , , , , 
রাজা ভোজের সভায় অনেক বিদ্বান ও সাহিত্যিক ছিলেন  । তার রাজ্যে সাহিত্য, কলা ও সংস্কৃতির খুব পৃষ্ঠপোষন করা হত  । তার রাজ্যে যে সাধারণ লোকেরাও সংস্কৃত জানত ও বলতে পারত তা আমরা "রাজা ভোজ ও কাঠুরে" গল্প হতে জানতে পারি ।
মহাকবি কালিদাস ছিলেন রাজা ভোজের সভার অন্যতম কবি  । কালিদাস আশুকবি ছিলেন  । আশুকবি হলেন তিনি যিনি তৎক্ষণাৎ কবিতা বানাতে পারতেন   । রাজা ভোজের নবরত্ন সভায় কালিদাস ছিলেন শীর্ষস্থানে ।
রাজা ভোজ কবিতা শুনে কবিদের পুরস্কৃত করতেন  ।

কবিরা কাব্য রচনা করে রাজসভায় শোনাতেন ও পুরস্কার পেতেন  ।
একবার মহাকবি কালিদাস বেরিয়েছেন ভ্রমণে । তিনি দেখলেন এক কবি জামগাছের নীচে বসে কাব্য রচনা করেছেন  । সেই কবি তার কবিতা সম্পূর্ণ করতে পারছেন না। এতে তিনি যথেষ্ট বিব্রতও ।
কালিদাস তার কাছে বিমর্ষতার কারন জানতে চাইলেন  ।
কবিবর তার বিমর্ষতার কারন কালিদাসকে জানালেন। 
"সরোবরের জলে পাকা জাম পড়েছিল  । মাছেরা সেই ফলের কাছে আসছিল কিন্তু ফল খাচ্ছিল না ।" সেই কবিবর এই ঘটনাকে কবিতার রূপ দেবার চেষ্টা করছিলেন  । এবং কবিতাটি রাজদরবারে শুনিয়ে ইনাম পেতে চাইছিলেন । কিন্তু কবিতাটি সম্পূর্ণ করতে পারছিলেন না  ।
কবিতাটি ছিল এইরকম - - - 
জম্মু ফলানি পক্কানি পতন্তি নির্মলে জলে তানি মৎস্যানি ন খাদন্তি  । ।
--------------------------------------
কবিতার দ্বিতীয় লাইন কোনোমতে মিলছিল না ।
মহাকবি কালিদাস তো আশুকবি ছিলেন, তাই তিনি কবিতা সম্পূর্ণ করেদিলেন । কবিতাটি হল এইরকম----
জম্মু ফলানি পক্কানি পতন্তি নির্মলে জলে 
তানি মৎস্যানি ন খাদন্তি  জাল গোটক শংকয়া।। 
অর্থাৎ - - - 
পাকা জামফল স্বচ্ছ জলে পড়েছিল । কিন্তু জাল গোটানোর আশঙ্কায় মাছেরা তা খাচ্ছিল না ।

বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১৮

Raja Voja & Wood cutter

রাজা ভোজ ও কাঠুরে :- 

রাজা ভোজ ও অন্যান্য গল্প - - - , , , , , ,
রাজা ভোজ ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ রাজা, যার নাম যেকোন লোকের মুখে মুখে ফেরে । লোক কথায় কথায় বলে "কোথায় রাজা ভোজ আর কোথায় গঙ্গুতেলি" বা "ভোজবাজী পেয়েছিস ?" । 
রাজা ভোজ ছিলেন 'ধার' নগরীর রাজা ।  তিনি তার রাজ্যে ভাষা-শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষন করেন - - যা সর্বজনবিদীত । বিদ্বান ও গুনীদের সমাদোর করতে তিনি খুবই ভালোবাসতেন  । তার শাসনে তার রাজ্যে সংস্কৃত ভাষার উৎকর্ষতা চরমে ওঠে । সাধারণ লোকেরাও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলতে  । 

একবার রাজা ভোজ বেরিয়েছেন ভ্রমণে  ।  রাস্তায় দেখলেন এক কাঠুরে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে আসছে  । মাথায় কাঠের বোঝা বেশি দেখে রাজা ভোজ কাঠুরেকে শুধালেন - - "ভারো  বাধতি ? " অর্থাৎ কাঠের বোঝা কি কাঠুরেকে কষ্ট দিচ্ছে ? 

কাঠুরে জবাব দিল - - "ভারো ন বাধতে রাজন যথা বাধতে বাধতি "  অর্থাৎ "হে রাজন ! মাথার উপর বোঝা আমাকে যতনা কষ্ট দিচ্ছে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পাচ্ছি আপনার মুখে 'বাধতি' শুনে।
রাজা ভোজ সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন ।  তার দ্বারা এমন ভূল হওয়া সম্ভব নয় । বাস্তবতা হল রাজা ভোজ তার নাগরিকদের সংস্কৃত ভাষায় কতটা জ্ঞান তা জানতে ইচ্ছুক ছিলেন ।  এজন্যই তিনি জেনেবুঝে 'বাধতে' শব্দকে 'বাধতি' বলেছেন । 
নিজের রাজ্যের সামান্য কাঠুরের মুখে সংস্কৃত ধাতুর শুদ্ধ প্রয়োগ শুনে রাজা ভোজ খুব আনন্দিত হন ও কাঠুরেকে পুরস্কৃত করেন । 
সংস্কৃত ভাষায় কিছু ক্রিয়াপদ আত্মনেপদী ও কিছু ক্রিয়াপদ পরস্মৈপদী হয় । কিছু ক্রিয়াপদ উভয়পদী হয় ।  অর্থাৎ আত্মনেপদী ও পরস্মৈপদী দুটিই প্রযুক্ত হয় । এইখানে সংস্কৃত বাক্যে আত্মনেপদী হবে ও 'বাধতি'  ।   

বুধবার, ৩০ মে, ২০১৮

Santhali folklore 2

সাঁওতালি উপকথা - - ২

সাঁওতালি উপকথা - - 

মৃতসংস্কার ও ভূমিকম্প

ওঁরাওদের কাছে "ধার্মেশ" সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা। ........সকলে একত্রে একবার ভগবানের কাছে গেল; আকুতি জানিয়ে ধার্মেশকে বললেন, ‘ভগবান, আমাদের মাঝে মৃত্যু দাও।’ ধার্মেশ বললেন, ‘তোমরা কি সকলের জন্যই মৃত্যু চাও।’ উত্তরে সবাই বলে, ‘না, যারা বৃদ্ধ, তাদের জন্য শুধু মৃত্যু দাও।’ দেবতা ধার্মেশ তাদের আবেদন মঞ্জুর করেন। ওঁরাওদের বিশ্বাস, সে থেকেই পৃথিবীতে মৃত্যুর আবির্ভাব হয়েছে।
তাহলে অন্য বয়সীদের কেন মৃত্যু হয়?.... ‘মানব সমাজে পাপের কারণে আত্মার পবিত্রতা নষ্ট হয়। আর এই অপবিত্র আত্মা তখন দেবতা ধার্মেশের কাছে চলে যায় এবং মৃত্যু কামনা করে। ফলে তখনই মানুষের শরীরে রোগব্যাধি দেখা দেয় এবং দেহের মৃত্যু ঘটে।’ আদিবাসী ওঁরাওরা তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের শক্তিতে বিশ্বাস করে। ওঁরাও ভাষায় এটি ‘পাকবলার’। এর অর্থ ‘অশরীরী আত্মা’। এদের বিশ্বাস পূর্বপুরুষদের আত্মার এই শক্তিই তাঁদের ভালো আদিবাসী এবং আদর্শ ঐক্যের পথে শক্তি জোগায়। বেঁচে থাকা ওঁরাওদের জন্য মৃতরা তাদের আশীর্বাদ রেখে যায়। তাই এরা মৃতদের ভক্তি করে। ভাত খেতে বসে এরা ভাতের কিছু অংশ পূর্বপুরুষদের নামে উৎসর্গ করে। কখনো কখনো নবজাতকের নাম রাখা হয় পূর্বপুরুষদের নামে, যাতে তাঁর আশীর্বাদ পাওয়া যায়।
ভূমিকম্প নিয়ে ওঁরাওদের প্রচলিত বিশ্বাসটির কথা। তারা মনে করে, পৃথিবী একটি কচ্ছপের পিঠের ওপর। কেঁচো পাতাল থেকে মাটি তুলে কচ্ছপের পিঠে ফেলে মই দিয়ে ওই মাটি সমান করে দেয়। এ কারণে পৃথিবীর কোথাও সমতল, কোথাও বা পাহাড়-পর্বত। কচ্ছপের মুখের সামনে নাগিনী সাপ ফণা তুলে বসে থাকে, যাতে কচ্ছপ নাড়াচড়া না করতে পারে। কচ্ছপ নাড়াচড়া করলেই ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়।
ওঁরাওদের কাছে গোত্র মহামূল্যবান। তাঁদের কাছে একই গোত্রের সকলেই ভাইবোন। ফলে এক গোত্রের মাঝে বিয়ে সম্পন্ন নিষিদ্ধ এবং পাপের সমতুল্য।.... ওঁরাওদের রয়েছে ২০টি গোত্র; নানা প্রাণী ও বস্তুর নামেই নামকরণ হয়েছে গোত্রগুলোর।
যেমন:-
১.  'টিগ্গা' অর্থ বানর,
২.  'বান্ডো' অর্থ বনবিড়াল,
৩.  'বাড়া' অর্থ বটগাছ,
৪.  'বাঁড়োয়া' অর্থ বন্যকুকুর,
৫.  'বাখলা' অর্থ এক প্রকার ঘাস,
৬.  'বেক' অর্থ লবণ,
৭.  'কেরকোটা' অর্থ চড়ুই পাখি,
৮.  'কিন্ড' অর্থ এক প্রকার মাছ,
৯.  'কিসপট্রা' অর্থ শূকরের নাড়িভুঁড়ি,
১০.  'কুজুর' অর্থ এক প্রকার লতাজাতীয় গাছ,
১১.  'লাকড়া' অর্থ বাঘ,
১২.  'মিঞ্জি' অর্থ এক প্রকার মাছ,
১৩.  'পান্না' অর্থ লোথা,
১৪.  'তির্কী' অর্থ এক জাতীয় মাছ,
১৫.  'টপ্প' অর্থ এক জাতীয় পাখি,
১৬.  'খাখা' অর্থ এক জাতীয় কাক,
১৭. 'খালখো' অর্থ এক জাতীয় মাছ,
১৮.  'খেস' অর্থ ধান,

Santhali folklore 1


সাঁওতালি উপকথা - ১



সাঁওতালি উপকথা - - 

খেরওয়াল বংশ ধরম পুথির" থেকে নেওয়া ঘটক কাহিনীটি... (SANTHALI MYTH)

ঘটককে কেন বাঘে খায় না?

বিয়ের ঘটক থাকে দুজন। একজন কনেপক্ষের, অন্যজন বরপক্ষের। একবার এক বিয়ের প্রস্তাবে কনের বাড়ি ছিল ধাড় দেশে। আর বরের শিলদাতে। বড় একটি জঙ্গলের পাশেই একত্রে এসে মিশেছে ধাড় দেশের নদী ও শিলদার নদীটি। কনেরবাড়ি থেকে বরের বাড়িতে যাওয়ার একমাত্র পথটি ছিল সে জঙ্গলের ভিতর দিয়েই। সে জঙ্গলে বাঘের উপদ্রব হতো প্রায়ই। জঙ্গলের পাশ দিয়ে চলে গেছে আরেকটি ছোট্ট নদী।
একবার কনেপক্ষের ঘটক বরের বাড়িতে যাচ্ছিল সে নদীর ধার দিয়ে। দূর থেকে ঘটককে যেতে দেখেই একটি বাঘিনী হুংকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ল তার সামনে। হঠাৎ বাঘিনীকে দেখে ঘটকের প্রাণ যায় যায়। বাঘিনী প্রথমে ঘটককে দুই থাবার মধ্যে নিয়ে খেলা করতে লাগল। এটাই বাঘদের নিয়ম। শিকারকে সঙ্গে সঙ্গে খায় না তারা।
সে সময় বাঘিনী ঘটককে জিজ্ঞেস করল, কে হে তুমি? কোথায় যাচ্ছিলে?
বাঘিনীর কথায় ঘটক একটু সাহস পেল। সে ভয়ে ভয়ে বলল, মহারানী, আমি ধর্মের কাজে যাচ্ছিলাম, আমাকে তুমি মেরো না।
ঘটকের উত্তরে বাঘিনীর বেশ কৌতূহল হলো। সে বলল, কেমন ধর্মের কাজ হে?
ঘটক বলল, আমি দুটি পরিবারকে একত্রিত করি। দুজন আলাদা লোককে একজনে পরিণত করি।
বাঘিনী বলে, কেমন করে?
ঘটক উত্তরে বলে, যার বউ নেই তাকে বউ জোগাড় করে দেই আর যার স্বামী নেই তার জন্য স্বামী জোগাড় করে দেই।
ঘটকের উত্তর শুনে বাঘিনীর নিজের কথা মনে হয়। সে বলে, যদি তাই হয়, আমার জন্যও স্বামী জোগাড় করে দাও। সে দুঃখ করে বলে, ১২ বছর আগে আমার স্বামীকে দুষ্ট লোকেরা মেরে ফেলেছে। সেই থেকে আমি একা।
সুযোগ বুঝে ঘটক বাঘিনীর কথায় রাজি হলো। সে বলল, তাহলে তো আমাকে কিছু সময়ের জন্য ছেড়ে দিতে হবে মহারানী। ঘটককে বিশ্বাস করে বাঘিনী তাকে ছেড়ে দিল।
ঘটকের ছিল তীক্ষ্ম বুদ্ধি। ছাড়া পেয়ে সে গেল সেই গ্রামে। অনেক খুঁজে গ্রামের ভেতর পেল একটা দোকান। দোকান থেকে সে দুটো নতুন বস্তা কিনে নিল। তা সেলাই করার জন্য কিনল একটি সুই ও দড়ি। ওই গ্রামের শেষ প্রান্তের বাড়িতে থাকত দুজন বুড়ো ও বুড়ি। গ্রামের যে কোনো বিয়েতে তারাই হলুদ ও পাতা বাছাই করে দিত।
ঘটক সে বাড়িতে গিয়ে খুশি মনে তাদের বলল, যাও, একটু হলুদ বেটে এবং পাতা বেছে পরগাছার সরু কাঠি দিয়ে শালপাতার চার কোণের খালা তৈরি কর। সেই খালায় দিয়ে দাও বাটা হলুদ ও তেলটুকু। বুড়ো-বুড়ি তাই করল।
ঘটক এবার নতুন বস্তা, সুই, শনের দড়ি ও তেল-হলুদ নিয়ে ফিরে গেল বাঘিনীর কাছে।
বাঘিনীকে সে বলল, মাহারাণী, তোমার জন্য পাত্রের সন্ধান পেয়েছি।
শুনে বাঘিনী তো মহা খুশি।
ঘটক বলল, যদি আমাকে বিশ্বাস কর এবং বিয়ে করতে চাও তবে তুমি এই বস্তার ভিতর প্রবেশ করো।
বিয়ের আনন্দে বাঘিনী ঘটকের কথা মতো বস্তার ভিতর ঢুকে পড়ল। ঘটক তখন সেই তেল-হলুদের খালাটি বাঘিনীর হাতে দিয়ে ভালো করে ধরে থাকতে বলল। সরল বিশ্বাসে বাঘিনীও তাই করল।
ঘটক এবার সেই শনের দড়ি দিয়ে ঐ বস্তাটিকে ভালো করে সেলাই করল। অতঃপর বাঘিনীকে বলল, মহারাণী, নড়াচড়া করো না। তোমাকে এই নদীর জলে নামিয়ে দিচ্ছি। এই জলের নিচেই তোমার স্বামী তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে যখন তোমাকে নদীর জল থেকে তুলে নেবে তুমি তখন হাতে থাকা তেল-হলুদ তার মুখে মাখিয়ে দিও।এ কথা বলেই ঘটক বস্তাটিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দিল।
সে দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। নদীতেও বান দেখা দিয়েছে। অন্য একটি গ্রামে ছিল একটি বাঘ। তার স্ত্রীকেও মানুষেরা মেরে ফেলেছে ১২ বছর আগে। সেই বাঘটি প্রতিদিন বান দেখতে নদীর ধারে এসে বসে থাকত। মাঝে মাঝে বানের জলে গরু, ছাগল, মহিষ ভেসে আসলেই নদী থেকে সে তা তুলে এনে খেত। সেদিনও সে নদীর ধারে বসেছিল। একটি বস্তা ভেসে আসতে দেখেই সে জলে নেমে সেটাকে উপরে তুলে আনল। দাঁত দিয়ে বস্তাটি ছিঁড়তে যাবে ওমনি বস্তার ভিতর থেকে বাঘিনীর গর্জন।
বাঘ তাড়াতাড়ি বস্তাটি ছিঁড়ে ফেলল। ঠিক তখনই বাঘিনী মনের আনন্দে আস্তে আস্তে বস্তা থেকে বেরিয়ে এলো। সে হাতের তেল-হলুদ বাটা ভালো করে মাখিয়ে দিল ওই পুরুষ বাঘটির মুখে এবং তাকে চুমু খেতে থাকল। অতঃপর তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সুখে- শান্তিতে কাটতে থাকল বাঘ-বাঘিনীর জীবন।
এ কারণেই আদি থেকেই সাঁওতালরা মনে করে বাঘেরা ঘটকদের ওপর খুব খুশি। তাই ঘটককে কখনো বাঘেরা খায় না।