শনিবার, ২২ অক্টোবর, ২০২২

বসন্ত পঞ্চম বা সরস্বতী পুজো

 বসন্ত পঞ্চমী বা সরস্বতী পুজো


সূচিপত্র * সরস্বতী স্তোত্রম্ 



  সূর্য যখন মকর রাশিতে অবস্থান করেন তখন শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় বাগদেবীর সরস্বতীর আরাধনা। আর এই পঞ্চমী তিথিকেই বসন্ত পঞ্চমী বলে। এদিন অধ্যয়ন বন্ধ থাকে। 

মাঘে মাসি সিতে পক্ষে পঞ্চমী যা শ্রিয়ঃ প্রিয়া।

তস্যাঃ পূৰ্ব্বাহু এবেহ কাৰ্যঃ সারস্বততাৎসবঃ ॥

শ্রীপঞ্চম্যাং লিখেম্নৈব ন স্বাধ্যায়ং কদাচন।

বাণীকোপমবাপ্পেতি লিখনে পঠনেহপি চ ৷।

স্মার্তপ্রবর রঘুনন্দনের মতে-

পঞ্চমাং পূজয়েল্লক্ষীং পুষ্পধূপান্নবারিভিঃ।

মস্যাধারং লেখনীঞ্চ পূজয়েন্ন লিখেত্ততঃ ॥

অর্থাৎ, এদিন লক্ষ্মী পুজোও করতে হয়।  

তিনি এও বলেছেন-

তিনি বলেছিলেন......

পঞ্চমাং পূজয়েল্লক্ষীং পুষ্পধূপান্নবারিভিঃ।

মস্যাধারং লেখনীঞ্চ পূজয়েন্ন লিখেত্ততঃ ॥

মাঘে মাসি সিতে পক্ষে পঞ্চমী যা শ্রিয়ঃ প্রিয়া।

তস্যাঃ পূৰ্ব্বাহু এবেহ কাৰ্যঃ সারস্বততাৎসবঃ ॥

শ্রীপঞ্চম্যাং লিখেম্নৈব ন স্বাধ্যায়ং কদাচন।

বাণী কোপম্ আনোতি লিখনে পঠনেহপি চ ।। 

মা সরস্বতী সম্মন্ধে ওঠা কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পড়ুন সরস্বতী মহাভাগে। এছাড়াও মূল সূচিপত্রের জন্য দেখুন সূচিপত্র । 

  দেবী সরস্বতী হলেন আদিদেবী। সৃষ্টির আদি যে প্রণব সেই প্রণবের উদগাতা হলেন সরস্বতী। তাই তো তিনি সৃষ্টিকর্ত্রী। এজন্যই অনেকসময় তাকে ব্রহ্মার শক্তি বলা হয়েছে। এই শক্তি মানে কিন্তু স্ত্রী নয়, ব্রহ্মা অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার নারীরূপ বিশেষ। 

দেবী সরস্বতীর বাহন হংস। এই হংস হল সূর্যের প্রতীক। সূর্য বা সবিতাই হলেন জগৎ প্রসবিতা। অর্থাৎ এখানেও সেই সৃষ্টি। ঋগ্বেদেও রয়েছে দেবী সরস্বতীর প্রশস্তি। 

অম্বিতমে নদীতমে সরস্বতী। 
অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি।। 
                                  (ঋগ্বেদ ২/৪১/১৬ ) 
অর্থাৎ “মাতৃকাদের  মধ্যে শ্রেষ্ঠ তুমি, নদীগণের মধ্যে তুমি শ্রেষ্ট,  হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী কর।”
শুধু সৃষ্টি নয় দন্ডনীতিরও প্রবক্তা দেবী সরস্বতী।মহাভারত বলছে, - 
 ‘সসৃজে দণ্ডনীতি সা ত্রিষু লোকেষু বিশ্রুতা’
অর্থাৎ দেবী সরস্বতী দণ্ডনীতির সৃষ্টি করেছিলেন।

 ঋকবেদ অনুসারে-

শন্নো দেবী বিশ্বদেবী ভবন্তু শং সরস্বতী সহ ধীতিরস্তু।

শমভিষাশ্চঃ শমু রাতিষশ্চঃ শংনাে দিব্যাঃ পার্থিবাঃ শন্নো অপ্যাঃ।।

এই বসন্তপঞ্চমী সম্পর্কে বলা হয় যে  মহাভারত লেখার পূর্বে ভগবান বেদব্যাস মা সরস্বতীর আরাধনা করেন। মা সরস্বতী তখন ভগবান বেদব্যাসের হাতে একটি কুল বা বদরি দিয়ে বলেন যে এই কুল হতে যে গাছ হবে সেই গাছ হতে প্রথম কুলটি যখন ব্যাসের কোলে পড়বে তখনই সাধনায় সিদ্ধ হবেন ব্যাস। কুলখানা মাটিতে পুঁতে তার পাশেই তপস্যায় বসেন ব্যাসদেব। আর সেই কুলের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ধীরে ধীরে তা বৃক্ষে পরিণত হয়। এবং যেদিন সেই গাছ হতে একখানা পাকা কুল ব্যাসদেবের কোলে পড়ে সেই দিনটি ছিল এই বসন্ত পঞ্চমী। আর ওই কুলগাছ বা বদরি বৃক্ষের নাম অনুসারেই জায়গাটির নাম হয় বদরিকাশ্রম।

আর এজন্যই কুল দিয়ে মা সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। এবং সরস্বতী পুজো পর্যন্ত কুল খাওয়া হয় না।

দেবী সরস্বতী শুধু যে হিন্দুদের দেবী তাই নন তিনি বৌদ্ধ ও জৈন্যদের দ্বারাও সমানভাবে উপাস্য। তিব্বতি ভাষায় দেবীর নাম 'ইয়েং চেনমা', জাপিনে আবার তিনি দেবী বেনজো। 

বৌদ্ধ সাধনমালায় তাঁর পাঁচটি রূপ দেখতে  পাই। মহাসরস্বতী, বজ্রবীণা সরস্বতী, আর্য সরস্বতী, সরস্বতী, বজ্র শারদা এবং বজ্র সরস্বতী।  বিহারের নালন্দা এবং ওড়িশার রত্নগিরিতে মহাসরস্বতীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। যদিও দেবী সরস্বতীর সঙ্গে দেবী মাতঙ্গীর অনেক প্রভেদ আছে তবুও বিচার করে দেখলে বোঝা যায় দেবী মাতঙ্গীই দেবী সরস্বতীর তান্ত্রিক রূপ। 

পুজার উপকরণ :-

সরস্বতী পুজোয় অন্যান্য পুজোর সাধারণ উপকরণের সাথে সাথে আম, জাম, ধান ও গমের শিষ, শরকাঠি ( কলম তৈরির জন্য ) , দোয়াত, কালি, টোপাকুল, পলাশ ইত্যাদি বসন্তের ফুল প্রয়োজন। 

হাতেখড়ি :-

অনেকে সরস্বতী পুজোর দিন নিজের পুত্রকন্যার বিদ্যারম্ভ বা হাতেখড়ি দেওয়া করান। অনেকে আবার এর একদিন পর মাকুড়ি সপ্তমীর দিনেও হাতেখড়ি দেন। একটা শ্লেটে গণেশের নাম লিখে তারপর অক্ষরগুলো লেখা করান। পুরোহিতমশাই বালক বা বালিকার হাতে ধরে এই কাজ সুসম্পন্ন করান। এদিন হতেই ওই বালক বা বালিকার বিদ্যারম্ভ হয়। বিদ্যারম্ভ বৃহস্পতিবারে শ্রেষ্ঠ। শুক্র ও রবিবার মধ্যম, শনি ও মঙ্গলবারে অল্পায়ু, বুধ ও সোমবারে বিদ্যাহীন হয়। 

এ নিয়ে জ্যোতিষতত্ত্বম সুস্পষ্ট ভাবে বলেছে-

সংপ্রাপ্তে পঞ্চমে বর্ষে অপ্রসুপ্তে জনার্দনে।

ষষ্ঠীং প্রতিপদঞ্চৈব বৰ্জ্জয়িত্বা তথাষ্টমীম্‌ ॥

রিক্তাং পঞ্চদশীঞ্চৈব সৌরিভৌমদিনং তথা।

এবং সুনিশ্চিতে কালে বিদ্যারম্ভন্তু কারয়েৎ।।  

 অর্থাৎ পাঁচ বছর বয়স হলেই হরিশয়নকাল, ষষ্ঠী, প্রতিপদ, অষ্টমী, রিক্তা, পূর্ণিমা, অমাবস্যা তিথি, শনি ও মঙ্গলবার পরিত্যাগ করে উত্তম দিনে বিদ্যারম্ভ করা উচিত ।

বিদ্যারম্ভের তিথি নিয়েও সঠিক নির্দেশিকা আছে এই  জ্যোতিষতত্ত্বমে। 

লঘুচরশিবমুলাধোমুখত্বষ্টৃপৌঞ্চশশিষু

 চ হরিরোধে শুক্রজীবার্কবারে।

উদিতবতি চ জীবে কেন্দ্রকোণেষু 

সৌম্যেরপঠনদিনবর্জং পাঠরেৎ পঞ্চমেহবৌ।।

বিদ্যারম্ভে গুরুঃ শ্রেষ্ঠো মধ্যমৌ ভৃগুভাস্করৌ।

মরণং শনিভৌমাভ্যামবিদ্যা বুধসোময়োঃ।

ষষ্ঠীং প্রতিপদঞ্চৈব বৰ্জ্জয়িত্বা তথাষ্টমীম্।।

রিক্তাং পঞ্চদশীঞ্চৈব শনিভৌমদিনং তথা।

শুভে সুনিশ্চিতে কালে বিদ্যারম্ভ প্রশস্যতে।।

অর্থাৎ, - 

চন্দ্র যখন পুষ্যা, অশ্বিনী, হস্তা,স্বাতী, পুনৰ্ব্বষু, শ্রবণা, ধনিষ্ঠা, শতভিষা, আর্দ্রা, মূলা, অশ্লেষা,কৃত্তিকা, ভরণী, মঘা, বিশাখা, পূর্বফাল্গুনী, পূর্ব্বাষাঢ়া, পূর্ব্বভাদ্রপদ, চিত্রা, রেবতী ও মৃগশিরা নক্ষত্রে অবস্হান করেন তখন হরিশয়ন সময় পরিত্যাগ করে উত্তরায়ণে শুক্র, বৃহস্পতি ও রবিবারে কালশুদ্ধিতে লগ্নের কেন্দ্র, পঞ্চম, ও নবম শুভগ্রহযুক্ত হলে পাঁচ বছর বয়সী সন্তানের বিদ্যারম্ভ করবে। 

সরস্বতীর ধ্যান মন্ত্র

ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্ব্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ। 

কুচভরণমিতাঙ্গী সন্নিষন্না সিতাব্জে।।

নিজকর কমলোদ্যল্লেখণী পুস্তকশ্রীঃ।

সকল বিভবসিদ্ধৌ পাতু বাগদেবতা নমঃ।।


মুকুলপুষ্প নিবেদন মন্ত্র : 


একটি  পাত্রে যবের শীষ, কুন্দ ফুল, পাঁচটি নারিকেল কুল, পলাশ ফুল, আমের মুকুল ,আবীর (ফল্গুচূর্ণ) নিম্নলিখিত মন্ত্রে উৎসর্গ করতে হবে - 

" ওঁ ইদং যবশীর্ষ কুন্দ বদর পলাশাম্রমুকুলাভ্রফল্গুচুর্ণাদিকম্ ওঁ লেখনী পুস্তক মস্যাধার বাদ্যযন্ত্রসহিতায়  ঐং সরস্বত্যৈ নমঃ। "

এছাড়াও নিম্নমন্ত্রে আমের মুকুল দেওয়াল যায় - 

ওঁ ক্ষীরসিক্তং চ্যুতপুষ্পং চন্দনেন সুবাসিতম্। নৈবেদ্যং বিশেষং তব ভক্তিতোহহং সমুৎসৃজে।।


সরস্বতী দেবীর গায়ত্রীঃ

ওঁ বাগ্দেব্যৈ বিদ্মহে কামরাজায় ধীমহি তন্নো দেবী প্রচোদয়াৎ।। 

সরস্বতী প্রণাম মন্ত্র

ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।

বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।

সরস্বতীর স্তবঃ

ওঁ শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেত পুষ্পোপশোভিতা।

শ্বেতাম্ভরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা।।

শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।

শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারব‌ভূষিতা

বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।

পূঝিতা মুনিভি: সর্ব্বৈঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা।।

স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।

যে স্মরতি ত্রিসন্ধ্যায়ং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে।।

সরস্বতী দেবীর স্তোত্রঃ

সরস্বতী মহাদৃষ্টা বীণাপুস্তকধারিণী।

হংসবাহন সংযুক্তা বিদ্যাদান করোম্যহম্।

প্রথমং ভারতীনাম দ্বিতীয়ঞ্চ সরস্বতী।

তৃতীয়ং সারদা দেবী চতুর্থে হংসবাহিনী। 

পঞ্চমে জগদ্বিখ্যাতা ষষ্ঠে বাকশ্বরীস্তথা।

সপ্তমে প্রখরতা চ অষ্টমে বরদায়িনী।

নবমে সিদ্ধিদাতা চ দশমে ব্রহ্মচারিণী। 

একাদশে চন্দ্রঘন্টা দ্বাদশে ভুবনেশ্বরী।।


সরস্বতীর পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র

ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।

বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ স্বাহা।।

এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি ওঁ সরস্বতৈ দেবৈ নমঃ।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন