সত্যনারায়ণের ব্রতকথা
স্কন্দপুরাণ রেবাখণ্ড
সূত-শৌনক সংবাদ
বন্দি দেব গজানন প্রথমে করি স্মরণ স্মরি যারে সর্ববাধা নাশ।
জগতের পিতামাতা বন্দি শিব-শৈলসুতা যার বরে এ কথা প্রকাশ।।
নমি দেবী সরস্বতী জিহ্বায় কর বসতি প্রণমামি শ্রী সহ শ্রীনাথ।
বন্দি যত ঋষিগণ শ্রীগুরু করি স্মরণ যত দেবদেবী বন্দি সাথ।।
স্কন্দপুরাণের কথা রেবাখণ্ডে উল্লেখিতা সূতমুখে শুন সর্বজন।
কি লাভ এ নরলোকে কি মাহাত্ম্য কি সুখে পুজিলে সত্যনারায়ণ ।।
শৌনকাদি যত ঋষি নৈমিষারণ্যেতে বসি শাস্ত্রাদি করেন আলোচন।
হেনকালে সূতবর শিষ্য সাথে অনন্তর উপস্থিত হলেন সেই স্থান।।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়ে ঋষি কহেন, হে জ্ঞানশশী কৃপাকরে বলুন অনিবার।
আগত এ কলিকালে পাপকর্ম বিস্তারিলে কেমনে হবে জগত উদ্ধার।।
স্বল্প আয়ু বেদহীন মূর্খ প্রগলভ দীন হরিভক্তি নাহি রবে হায় ।
কেমনে কলির জীবে মহাপাপে উদ্ধারিবে, কৃপাকরে বলহ উপায়।।
শুনিয়া শৌণক কথা সূত কহে এ বারতা শুনিয়াছি নারদ বচনে।
একদা কমলাপতি ক্ষীরোদ সাগরে স্থিতি শ্রী-শ্রীপতি ব্যস্ত আলোচনে।।
মন্দ মন্দ বহে বায় শ্রীঅঙ্গ সৌরভ ধায় চতুর্দিকে কমল আলয়ে।
বীণাহাতে মুনিবর তথা এল সত্বর হরিগানে মুখরিত হয়ে।।
শঙ্খচক্রধর হরি চতুর্ভূজ সে মুরারী কি সুন্দর বনমালা গলে।
শ্যামবর্ণ স্মিতহাস কোটিসূর্য পরকাশ কমলা বসিয়া পদতলে।।
নারদ জুড়িয়া কর কহিল অনন্তর, হে প্রভু হে বাগমনোতীত।
সর্বরূপধর হরি ভক্ত আর্তি নাশকারী কর মম দুঃখের বিহিত ।।
করিলাম পর্যটন শসাগরা ও ভুবন দেখি জীব সদা দুঃখে মরে।
নানা পাপ করে করে নানা যোনী ঘুরে ঘুরে ভাসে সদা সন্তাপ সাগরে।।
বলো প্রভু কি উপায় কি ভাবে এ দুঃখ যায় বিষ্ণুভক্তি উপার্জে হৃদয়ে।
কহয়ে কমলাকান্ত, হে নারদ হও শান্ত শুন আমি বলি বিস্তারিয়ে।।
সত্যনারায়ণ ব্রত করিলে বিধিমত চতুর্বর্গ ফলপ্রাপ্তি ঘটে।
দুঃখ তার দূরে যায় বাঞ্ছিত ফল পায় দেশে দেশে খ্যাতি তার রটে।।
এ শুনিয়া মুনিবর বলে কহ পীতাম্বর কি রূপে হইবে এই ব্রত।
কি ফল হয় হে হরি বলহ কৃপাকরি কেমনে হও দেব প্রীত।।
কহিলেন জনার্দন দুঃখশোক বিনাশন ধনধান্য বাড়ে ব্রতফলে।
সৌভাগ্য বিজয় পায় আনন্দে উছলি গায় ব্রাহ্মণ-বান্ধব সাথে মিলে।।
হয়ে শাস্ত্রপরায়ণ নৈবেদ্য দেয় হৃষ্টমন ক্ষীর আর কদলী সহিত।
গোধূমের চূর্ণ সাথে শর্করা বা গুড় তাতে গোধূমাভাবে শালীচূর্ণ রীত।।
ব্রাহ্মণ দক্ষিণা পায় সর্বজন নৃত্যগায় প্রসাদ লয় হরষিত চিতে।
স্মরি সত্যনারায়ণ স্বগৃহে করে গমন বাঞ্ছাপূর্ণ হয় আচম্বিতে ।।
সত্যনারায়ণ কথা যেন অমৃতের স্রোতা পান করে ধন্য ভক্তজন।
দ্বিজ সুব্রত গায় রেবাখণ্ডে লেখা তায় এইখানে হইল সমাপন।।
ব্রাহ্মণের কথা
শ্রীভগবান কথা অপূর্ব এক গাঁথা বলি আজ শুন সর্বজনে।
ছিল এক দ্বিজবর কাশীপুর ভিতর ভ্রমে মহী ভিক্ষার কারণে।।
ব্রাহ্মণের দুঃখ হেরি জগৎ পালনকারী বৃদ্ধরূপে অবতীর্ণ হয়ে।
জিজ্ঞাসিল ব্রাহ্মণেরে, হে দ্বিজ কিসের তরে থাক সদা নিরানন্দ হয়ে।।
দ্বিজ বলে ভাগ্য ফেরে বৃথা মরি ঘুরে ঘুরে না মেলে খানিক খুদকুঁড়া।
অন্নাভাবে ক্ষীণ দেহ দয়া না করয়ে কেহ দুঃখ মোর সুমেরুর চূড়া ।।
বৃদ্ধ কয় শোনো বিপ্র ঘরে যাও অতি শীঘ্র পুজা কর সত্যনারায়ণ।
সর্বদুঃখ দূরে যাবে বাঞ্ছিত ফল পাবে শ্রীহরির পদে দিলে মন।।
শুনে দ্বিজ ফিরে যায় হরির মন্দির পায় ব্রত করে নিষ্ঠাযুক্ত হয়ে।
সর্বদুঃখ দূরে গেল ধনসম্পত্তি পেল অন্তে গেল বৈকুণ্ঠ আলয়ে।।
এমতে প্রচারে কথা হয়ে সব ভক্তিযুতা মাসে মাসে পুজে নারায়ণে।
সুব্রতর কি আনন্দ রচিয়া পাঁচালি ছন্দ ব্রতকথা সত্যনারায়ণে।।
কাষ্ঠকেতুর উপাখ্যান
শৌনক কহেন মুনি ইচ্ছা হয় আরও শুনি অতঃপর কি হলো বিস্তারে।
সুত বলে মুনিগণ মন্দিরেতে সে ব্রাহ্মণ ব্রত করে বান্ধব সহকারে। ।
হেনকালে কাঠ লয়ে মন্দিরের পথ দিয়ে কাষ্ঠকেতু যায় নিজঘর।
তৃষ্ণায় কাতর প্রায় কাঠ রাখি বাহিরায় মন্দিরেতে প্রবেশে সত্তর ।।
ব্রত দেখি কাষ্ঠকেতু বলে ব্রত কি হেতু এ ব্রতের ফলে কিবা মেলে।
ব্রাহ্মণ কহিল শোনো সুখ মেলে আগণন ধনধান্য এ ব্রতের ফলে।।
শুনি হরষিত হয়ে ব্রতের প্রসাদ লয়ে কাষ্ঠকেতু যাইল নগরে।
লভিল প্রচুর ধন কাষ্ঠ হইল কাঞ্চন আনন্দে শ্রীহরিরে ফুকারে।।
গৃহে গিয়া করে ব্রত শর্করা কদলী কত গোধূমচূর্ণের সহিত।
সাথে ঘৃত দুগ্ধ দিয়ে ব্রতের প্রসাদ লয়ে কাষ্ঠকেতু হরষিত চিত।।
অপার সম্পদ পায় পুত্রপৌত্র রাখি তায় অন্তে যায় বৈকুণ্ঠনগর।
সত্যনারায়ণ কথা অমৃতের সরসতা সুব্রত কয় আনন্দমুখর ।।
লীলাবতী ও কলাবতীর উপাখ্যান
সুত বলে শুন মুনি আরেক মাহাত্ম্য শুনি উল্কামুখ নামে এক রাজা।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় মহাবীর সুপ্রিয় ব্রাহ্মণবৎসল মহাতেজা।।
ভার্যা সহ ব্রত করে সত্যনারায়ণে স্মরে গীতবাদ্য বহু ধুমধামে।
দেখি পুজা সমারোহ বাণিজ্য শকট সহ বণিক এক সেই স্থলে থামে।।
কৌতুহলী সাধুবর দেখে সব অনন্তর বলে দুই হাত জোড় করি।
কি করহ মহারাজ এ ব্রতের কিবা কাজ বলহ আমারে বিস্তারি।।
রাজা বলে শুন শুন সাধুর তণয় ।
এই ব্রত হতে মোর ভাগ্যের উদয় ।।
সত্যনারায়ণ বরে দুঃখ গেছে দূর।
পুত্রপৌত্র ধনধান্য হয়েছে প্রচুর।।
শুনি সাধু বলে রাজা মুই নিঃসন্তান।
পুত্র হেতু করিব ব্রত বলহ বিধান।।
বিধান লইয়া সাধু গেল নিজ ঘরে।
একনিষ্ঠ হয়ে সত্যনারায়ণে স্মরে।।
গৃহে আসি সাধুবরে ভার্য্যা সনে বিস্তারে সত্যনারায়ণ ব্রতকথা।
শুনি ভার্য্যা লীলাবতী হরিপদে রাখি মতি বলে এ সুখের বারতা।।
নিশ্চয় করিব ব্রত পুত্রকন্যা মনোমত হয় যদি নারায়ণ বরে।
সংকল্প করিবা ফলে গর্ভ তার উপজিলে আনন্দে মাতয়ে সাধুবরে।।
কন্যা নামে কলাবতী জনমিল যেন রতি সুধাকর যেন ধরাতলে।
কন্যা পেয়ে সাধুবর হরষিত অন্তর সত্যনারায়ণে গেল ভুলে।।
কন্যা বাড়ে শশিকলা যথাকালে বিভা দিলা ভুলিয়া সত্যনারায়ণ।
জামাতা লয়ে সাধুরায় হরষে বাণিজ্য যায় চন্দ্রকেতু রাজার সদন।।
রাত্রিকালে চোর আসি রাজার আলয়ে পশি চুরি করে সোনার কঙ্কন।
চোরে দেখি সাধু ধায় রাজসৈন্য পিছে তায় চোর তাহে আতঙ্কিত মন।।
সোনার কঙ্কনজোড়া সাধু হাতে দিয়ে চোরা পথিমধ্যে হইল অদর্শন ।
রাজসৈন্য এসে ধরে কঙ্কন হাতে সাধুবরে বলে কোথা যাইবি এখন।।
জামাতা শ্বশুর উভে বন্দি করি সৈন্য সবে চন্দ্রকেতু সদনেতে যায়।
কোপে রাজা বলে দোহে বন্দি রাখ কারাগৃহে এ অন্যায় আর নাহি সয়।।
না ফিরিল সাধুবর সপ্তডিঙা মধুকর গৃহ হল অলক্ষ্মী আলয়।
অন্ন লাগি কলাবতী দ্বারে দ্বারে ফেরে নিতি এ দুখ্ আর নাহি সয়।।
একদা প্রদোষকালে কি জানি দৈবের বলে এক গৃহে গেল কলাবতী।
সত্যনারায়ণ ব্রত করে তথা লোক কত দেখিয়া হইল তার প্রীতি ।।
করে ব্রত সেইক্ষণ হয়ে হরষিত মন প্রসাদ লয়ে ঘরে ফিরে যায় ।
চন্দ্রকেতু ঘুমঘোরে সত্যনারায়ণে হেরে কহে দেব শুন রাজারায়।।
বন্দি আছে সাধুবর তারে অগ্রে মুক্ত কর দাও তারে ধনরত্ন মণি ।
রাজা কহে জোড় কর হে দেব পরমেশ্বর আজ্ঞা তব শিরোধার্য মানি।।
সাধুবর মুক্ত হয়ে ধনধান্য জামাতা লয়ে প্রবেশিল আসি নিজ গ্রামে।
হয়ে হরষিত মন স্মরে সত্যনারায়ণ ব্রত করে মহা ধুমধামে।
ব্রাহ্মণে দক্ষিণা দেয় নারায়ণ কথা গায় ভোজন করায় যতজনে।
সত্যনারায়ণ কথা কলাবতীর গাথা সুব্রত ভণে হরষিত মনে।।
তুঙ্গধ্বজ রাজার উপাখ্যান
সূত বলে শুন মুনি তুঙ্গধ্বজ রাজা জানি মহাবীর ন্যায়পরায়ণ।
মৃগয়া করিবা তরে বনমধ্যে গিয়া হেরে ব্রত করে যত গোপগন।।
তুঙ্গধ্বজ অহঙ্কারে নারায়ণে নাহি স্মরে নাহি লয় পুজার প্রসাদে।
বলে রাজা কিবা লাভ মোর আছে কি অভাব আলোর অভাব কিবা চাঁদে।।
নারায়ণ কোপে পড়ি রাজ্য নাশে জ্বলে পুরী তুঙ্গধ্বজ ভাসে অশ্রুজলে।
বলে রাজা মোর পাপে সত্যনারায়ণ শাপে রাজ্যপাট সব নিল কালে।।
অনুতপ্ত তুঙ্গধ্বজে সত্যনারায়ণে পুজে গিয়া বনে গোয়ালা সহিতে।
নষ্টরাজ্য ফিরে পায় ধনধান্যে ভরে যায় অন্তকালে যায় বৈকুণ্ঠেতে।।
সত্যনারায়ণ কথা যেন অমৃতের স্রোতা সুব্রত গায় আনন্দাভিরাম ।
হয়ে হরষিত মন বলো সত্যনারায়ণ এইখানে পাঁচালি বিরাম।।
-শুভমস্তু-